
আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোনের ক্যামেরা, সকালে ঘুম ভাঙানো কফির কাপ, বা গণিতের 'X'... ভেবে দেখেছেন এগুলোর শুরুটা কোথায়? চলুন এক অবাক করা সফরে যাওয়া যাক!
ভূমিকা: টাইম মেশিনে চড়ে এক স্বর্ণালী অতীতে
আমরা যখন আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকাই, তখন গুগল, অ্যাপল বা টেসলার মতো উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানের কথাই আমাদের প্রথমে মনে আসে। কিন্তু আজকের এই প্রযুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল শত শত বছর আগে। মধ্যযুগে যখন ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিল, তখন মুসলিম বিশ্ব ছিল আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু।
আজ আমরা এমন পাঁচটি অসাধারণ আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করব, যা মুসলিম বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের হাত ধরে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে এবং আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে আছে।
১. কফি: পানীয় থেকে সামাজিকতার কেন্দ্রবিন্দু
আজকের দিনে আমাদের অনেকেরই সকাল শুরু হয় এক কাপ গরম কফি ছাড়া। কিন্তু আপনি কি জানেন এই জনপ্রিয় পানীয়টির আবিষ্কারক কারা? ৯ম শতকে ইথিওপিয়ার এক ছাগল পালক, খালিদ, প্রথম কফি বিনের উত্তেজক প্রভাব লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন যে, তার ছাগলগুলো একটি নির্দিষ্ট ফল খাওয়ার পর অনেক বেশি চঞ্চল হয়ে উঠছে।

এই আবিষ্কারটি ইয়েমেনের মুসলিম সুফিদের কাছে পৌঁছালে তাঁরাই প্রথম কফি বিন রোস্ট করে এবং পিষে গরম পানির সাথে মিশিয়ে পানযোগ্য করে তোলেন। তাঁরা রাতের বেলা ইবাদতে সজাগ থাকার জন্য এই পানীয় পান করতেন। দ্রুতই কফি মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং মক্কা, কায়রো ও ইস্তাম্বুলের কফি হাউসগুলো জ্ঞানচর্চা ও সামাজিকতার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
২. ক্যামেরা: যেভাবে আমরা পৃথিবীকে দেখি
স্মার্টফোনের এক ক্লিকে ছবি তোলা আজ কতটা সহজ! কিন্তু এর পেছনের মূলনীতিটি এসেছিলো প্রায় এক হাজার বছর আগে, ১০ম শতকের মুসলিম বিজ্ঞানী ইবন আল-হাইথামের হাত ধরে। তাকে আধুনিক অপটিক্স বা আলোকবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, আলো সরলরেখায় চলে এবং আমাদের চোখে প্রবেশ করার কারণেই আমরা দেখতে পাই। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তিনি বিশ্বের প্রথম "ক্যামেরা অবস্কিউরা" (Camera Obscura) বা পিনহোল ক্যামেরা তৈরি করেন। একটি অন্ধকার বাক্সের একপাশে একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে তিনি বাইরের কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব বাক্সের ভেতরের দেয়ালে ফেলতে সক্ষম হন। তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারই আজকের আধুনিক ক্যামেরার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
৩. সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা: জীবনের নতুন আশা
দশম শতকে মুসলিম স্পেনের অন্যতম সেরা চিকিৎসক ছিলেন আল-যাহরাউয়ি। তাঁকে আধুনিক সার্জারির জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি প্রায় ২০০টি সার্জিক্যাল যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার মধ্যে স্ক্যাল্পেল (ছুরি), ফোরসেপ (চিমটা), এবং হাড় কাটার করাত উল্লেখযোগ্য। তাঁর নকশা করা অনেক যন্ত্র আজও সামান্য পরিবর্তন করে সার্জনরা ব্যবহার করেন।

তিনিই প্রথম সিলাইয়ের জন্য বিড়ালের অন্ত্র থেকে তৈরি সুতা (Catgut) ব্যবহার করেন, যা মানবদেহের সাথে মিশে যায় এবং অপারেশনের পর দ্বিতীয়বার খোলার প্রয়োজন হয় না। তাঁর লেখা বিশ্বকোষ "আল-তাকরিফ" পরবর্তী ৫০০ বছর ধরে ইউরোপের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার সূচনা
উচ্চশিক্ষার জন্য আমরা আজ যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাই, তার প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাটিও মুসলিম বিশ্ব থেকেই এসেছে। ৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেজ শহরে ফাতিমা আল-ফিহরি নামের একজন মহীয়সী নারী বিশ্বের প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় "আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়" প্রতিষ্ঠা করেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো চালু আছে এবং এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সক্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। এখান থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান এবং একটি নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুসরণ করার ধারণাটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
৫. অ্যালজেবরা (বীজগণিত): গণিতের এক নতুন দিগন্ত
গণিত ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অকল্পনীয়। আর গণিতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা অ্যালজেবরা বা বীজগণিতের ভিত্তি স্থাপন করেন ৯ম শতকের পার্সিয়ান গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি। তাঁর বিখ্যাত বই "কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকা'বালা" থেকেই "আল-জাবর" শব্দটি পরিমার্জিত হয়ে আজকের "অ্যালজেবরা" নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনিই প্রথম সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতিগত নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কাজ না থাকলে আজকের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যন্ত কোনো কিছুই সম্ভব হতো না। তাঁর নাম থেকেই "অ্যালগরিদম" শব্দটি এসেছে।
উপসংহার
এই পাঁচটি আবিষ্কার মুসলিম সভ্যতার অসামান্য অবদানের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাঁদের এই অনুরাগই একসময় অন্ধকার ইউরোপে আলোর মশাল জ্বেলেছিল এবং রেনেসাঁর পথ তৈরি করেছিল। তাঁদের এই অবদানকে স্মরণ করা আমাদের ইতিহাসকে জানা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সম্পর্কিত আলোচনা পড়ুন
মুসলিম সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাস এবং বিখ্যাত মসজিদগুলোর স্থাপত্য ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।
পোস্টটি পড়ুন