
ভূমিকা
আমরা যদি দুনিয়ার সবকিছু পেয়েও আল্লাহকে না পাই, তবে আমাদের জীবন ব্যর্থ। আর যদি সবকিছু হারিয়েও আল্লাহকে পেয়ে যাই, তবে এর চেয়ে বড় সফলতা আর নেই। কিন্তু কীভাবে সেই মহান রবের নৈকট্য লাভ করা যায়? কোন পথে চললে দুনিয়ার যাবতীয় ফেতনা থেকে বেঁচে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব?
এই গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআনের অলৌকিক শক্তির মধ্যে। সম্প্রতি প্রখ্যাত আলেম মুফতি মেরাজুল হক মাযহারী তাঁর এক ঈমানদীপ্ত আলোচনায় কোরআনের ক্ষমতা এবং আধুনিক বিনোদনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঈমানবিধ্বংসী ষড়যন্ত্র নিয়ে এমন কিছু বাস্তবসম্মত কথা বলেছেন, যা প্রতিটি মুমিনের জন্য চিন্তার খোরাক জোগাবে। চলুন, সেই Bangla Waz থেকে প্রাপ্ত আলোচনার গভীরে প্রবেশ করি এবং খুঁজে বের করি আমাদের করণীয়।
১. শব্দের অলৌকিক শক্তি: একটি গালি এবং কোরআনের শিফা
আলোচনার শুরুতেই মেরাজুল হক মাজহারী ফখরে বাঙ্গাল (রহঃ) এর একটি অসাধারণ ঘটনা তুলে ধরেন। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, হুজুর, আপনারা যে ফুঁ দেন, তাতে কীভাবে রোগ ভালো হয়? এর মধ্যে তো কোনো ওষুধ নেই।
হুজুর লোকটিকে তিনবার ওয়াদা করালেন যে তিনি রাগ করবেন না। এরপর বললেন, তোমাকে তো ভালো মানুষ মনে হয়, কিন্তু আসলে তুমি একটা হারামজাদা।
এই একটি মাত্র শব্দ শোনার সাথে সাথে লোকটি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তখন ফখরে বাঙ্গাল (রহঃ) তাকে বোঝালেন:
নিজস্ব প্রতিফলন: এই ঘটনাটি আমাদের চোখ খুলে দেয়। আমরা প্রায়ই শব্দের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করি। একটি মন্দ কথা যেমন মানুষের অন্তরকে রক্তাক্ত করতে পারে, ঠিক তেমনি আল্লাহর জিকির এবং কোরআনের আয়াত আমাদের আত্মা ও দেহে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিতে পারে। কোরআন নিজেই এক মহৌষধ বা ‘শিফা’।
২. কোরআনের অমোঘ আকর্ষণ: আবু জাহেলও যা এড়াতে পারেনি
পবিত্র কোরআনের আকর্ষণ এতটাই তীব্র যে, ইসলামের ঘোর শত্রুও এর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারত না। দিনের বেলায় যে আবু জাহেল, আবু সুফিয়ানরা মানুষকে কোরআন শুনতে বারণ করত, রাতের আঁধারেই তারাই লুকিয়ে লুকিয়ে রাসূল (ﷺ) এর তাহাজ্জুদের তেলাওয়াত শুনত।

পরপর তিন রাত তারা একে অপরকে তেলাওয়াত শোনার সময় ধরে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত আবু জাহেল স্বীকার করতে বাধ্য হয়, মোহাম্মদ যা বলে, সবই সত্য। কিন্তু আমি যদি তা মেনে নিই, আমার নেতৃত্ব থাকে না।
নিজস্ব প্রতিফলন: এই ঘটনা প্রমাণ করে, কোরআনের বাণী ও সুর কতটা শক্তিশালী ও আকর্ষণীয়, যা অস্বীকার করার ক্ষমতা কঠোরতম অন্তরেরও নেই। অথচ আমরা মুমিন হয়েও সেই কোরআনের তেলাওয়াতকে উপেক্ষা করে অন্যান্য বিনোদনে মগ্ন থাকি।
৩. ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র বনাম আধুনিক ফাঁদ: কোরআনকে রুখতে গানের ব্যবহার
কাফেররা যখন দেখল কোরআনের আকর্ষণ থেকে মানুষকে ফেরানো যাচ্ছে না, তখন তারা এক নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনল। নজর ইবনে হারেস নামক এক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে সুন্দরী গায়িকা এবং বিভিন্ন গল্প-গুজবের বই নিয়ে আসে। যখনই কেউ নবীর কাছে কোরআন শুনতে যেতে চাইত, সে তাকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে গান-বাজনা ও গল্পের মাধ্যমে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিত।
মাওলানা মেরাজুল হক মাযহারী বলেন, নজর ইবনে হারেসের সেই ষড়যন্ত্র আজ আরও ভয়াবহ রূপে আমাদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন, সিনেমা এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে। আল্লাহ তা'আলা এই ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যেই বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
অনুবাদ: এক শ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদিস (গান-বাজনা ও অনর্থক কথাবার্তা) ক্রয় করে।
- সূরা লোকমান, আয়াত: ৬
নিজস্ব প্রতিফলন: গান-বাজনা ও অপসংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়, এটি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার এক সুপ্রাচীন ষড়যন্ত্রের আধুনিক রূপ। আমাদের অজান্তেই আমরা এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ঈমানকে দুর্বল করে ফেলছি।
৪. আপনার ঈমানের পরীক্ষা: দুধ নাকি মাখন?
Maulana Merajul haq একটি অসাধারণ উপমা দিয়ে বলেন, প্রতিটি শিশু দুধের মতোই পবিত্র ও তরল ঈমান নিয়ে জন্মায়। সেই দুধকে যদি নদীর পানিতে (খারাপ পরিবেশে) ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তা সহজেই মিশে একাকার হয়ে যায়। একইভাবে, কোরআনি শিক্ষা ছাড়া একজন মুসলিম সন্তান সহজেই বিজাতীয় সংস্কৃতিতে মিশে তার পরিচয় হারিয়ে ফেলে।

কিন্তু সেই দুধের ওপর যদি মেহনত করে তাকে মাখনের চাকায় পরিণত করা হয়, তবে তাকে বঙ্গোপসাগরে ছেড়ে দিলেও সে তার অস্তিত্ব হারায় না। ঠিক তেমনি, শৈশবে যদি সন্তানের অন্তরে কোরআনের শিক্ষা দিয়ে ঈমানকে শক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে সে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে গেলেও নিজের মুসলিম পরিচয় কখনো ভুলবে না।
৫. ঈমান রক্ষার ইস্পাত-কঠিন বর্ম: হযরত ওমরের (রাঃ) সেই কালজয়ী শিক্ষা
কোরআন কীভাবে ঈমানকে রক্ষা করে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলের একটি ঘটনা। একদল মুসলিম সৈন্য মিশর অতিক্রম করার সময় শত্রুরা তাদের ঈমান নষ্ট করার জন্য রাস্তায় সুন্দরী নারীদের নাচ-গানের আয়োজন করে।
সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) খলিফার কাছে চিঠি পাঠালে উত্তরে হযরত ওমর (রাঃ) কোরআনের একটি আয়াত লিখে পাঠান: আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে। (সূরা নূর: ৩০)।
মুসলিম সৈন্যরা সেই আয়াত তেলাওয়াত করতে করতে এবং নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রেখে সেই পথ অতিক্রম করেন। তাদের ঈমানি শক্তি দেখে সেই নারীরাই পরে ইসলাম গ্রহণ করে। এই islamic video থেকে পাওয়া ঘটনা আমাদের দেখায় যে, কোরআনের আমলই হলো সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
এক নজরে আলোচনার সারমর্ম
শব্দের শক্তি
একটি মন্দ শব্দের যদি তীব্র প্রতিক্রিয়া থাকে, তবে কোরআনের পবিত্র শব্দের শক্তি ও শিফা অপরিমেয়।
কোরআনের আকর্ষণ
এর তেলাওয়াত এতই শক্তিশালী যে আবু জাহেলের মতো শত্রুও গোপনে তা শুনত।
বিনোদনের ফাঁদ
গান-বাজনা ও অপসংস্কৃতি হলো কোরআন থেকে দূরে সরানোর একটি ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র।
ঈমানের রক্ষাকবচ
সিনায় কোরআন এবং জীবনে এর আমল থাকলে দুনিয়ার কোনো ফেতনাই ঈমান নষ্ট করতে পারে না।
ঈমানের ভিত্তি
সন্তানের কচি মনে কোরআনের শিক্ষা দিলে তার ঈমান মাখনের মতো শক্ত হয়, যা সহজে নষ্ট হয় না।
আপনার জন্য করণীয়: আজ থেকেই শুরু করুন
- কোরআনকে অগ্রাধিকার দিন: প্রতিদিন বিনোদনের সময় থেকে অন্তত ১০ মিনিট কমিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করুন বা তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন।
- ঘরকে পবিত্র রাখুন: নিজের ঘরকে গান-বাজনা ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। যেখানে কোরআনের তেলাওয়াত হবে, সেখান থেকে শয়তান দূরে থাকবে।
- সন্তানকে কোরআন শেখান: সন্তানের মুখে প্রথম কথা হিসেবে আল্লাহ, রাসূল এবং কালেমা তুলে দিন। তাকে গান বা কার্টুনের হাফেজ না বানিয়ে কোরআনের সাথে সম্পর্ক গড়ে দিন।
- জ্ঞান ছড়িয়ে দিন: এই পোস্টটি আপনার বন্ধু বা পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের সাথে শেয়ার করুন, যেন তারাও এই ফেতনা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন ১: কোরআনের তেলাওয়াত শোনা কি কোরআন পড়ার মতোই সওয়াবের?
উত্তর: হ্যাঁ, মনোযোগ সহকারে কোরআন তেলাওয়াত শোনাও একটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। আল্লাহ বলেন, যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সাথে তা শোনো এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত হয়। (সূরা আরাফ: ২০৪)।
প্রশ্ন ২: আমি তো কোরআন পড়তে জানি না, আমার করণীয় কী?
উত্তর: কোরআন পড়তে না জানলে শেখার চেষ্টা করা প্রথম দায়িত্ব। পাশাপাশি, আপনি নির্ভরযোগ্য আলেমদের তেলাওয়াত শুনতে পারেন এবং কোরআনের বাংলা অনুবাদ ও তাফসীর পড়তে পারেন। মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বাণী বোঝা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করা।
প্রশ্ন ৩: ইসলামে কি সব ধরনের বিনোদনই হারাম?
উত্তর: না, ইসলামে সব বিনোদন হারাম নয়। যে বিনোদন মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার দিকে ঠেলে দেয়, তা বর্জনীয়। ইসলামসম্মত উপায়ে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে।
উপসংহার
মেরাজুল হক মাজহারীর এই new waz আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমরা কি কোরআনের আকর্ষণীয় তেলাওয়াতকে বেছে নেব, নাকি শয়তানের সাজানো বিনোদনের ফাঁদে পা দেব? সাহাবায়ে কেরাম কোরআনকে ধারণ করে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফেতনাকে জয় করেছিলেন। আসুন, আমরাও গান-বাজনা পরিহার করে কোরআনকে আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি বানাই এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জন করি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআনের আলোয় জীবন আলোকিত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।