এক হাতে স্মার্টফোন, অন্য হাতে সংসারের হাল—আমাদের জান্নাতি মায়েদের মিষ্টি বিবর্তন

এক হাতে স্মার্টফোন, অন্য হাতে সংসারের হাল—আমাদের জান্নাতি মায়েদের মিষ্টি বিবর্তন

যুগ বদলেছে, কিন্তু মায়ের মুখের সেই অমলিন হাসিটা বদলায়নি

আমাদের ছোটবেলায় "মা" মানে ছিল রহমত আর বরকতের এক চলমান প্রতিষ্ঠান। সেই মায়েদের রান্নার জন্য কোনো ইউটিউব টিউটোরিয়াল লাগত না, মেপে মেপে মসলা দেওয়ার বালাই ছিল না। তাদের হাতের আন্দাজ আর "বিসমিল্লাহ" বলে শুরু করাটাই ছিল সেরা রেসিপি। শিলনোড়ায় মসলা বাটার সেই ছন্দময় শব্দ আর ফজরের পর তাদের তিলাওয়াতের সুর ছিল আমাদের শৈশবের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

কিন্তু যুগ বদলেছে। শিলনোড়া এখন স্মৃতির জাদুঘরে, আর স্মার্টফোন এখন মায়েদের হাতে হাতে। আমাদের সেই জান্নাতি মায়েরা এখন ফেসবুকের ইসলামিক গ্রুপ আর রান্নার পেজে একজন "ডিজিটাল দাইয়ি"। তাদের জীবনের মূলমন্ত্র এখন একটাই—"আলহামদুলিল্লাহ, এই গ্রুপে অ্যাড হওয়ার পর দ্বীন ও দুনিয়া দুটোই শিখে গেলাম!"

চলুন, মায়েদের এই মিষ্টি বিবর্তনের কয়েকটি ধাপ দেখে আসি, যা পড়লে আপনার মুখে হাসি আর হৃদয়ে প্রশান্তি দুটোই আসবে।

অধ্যায় ১: শিলনোড়ার যুগ থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ ক্যাপশনের যুগে

আগের পর্ব: মনে আছে, ঈদের আগে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত শিলনোড়ায় মসলা বাটার "ধুমধারাক্কা" শব্দে? মা যেন একাই একটা অর্কেস্ট্রা চালাচ্ছেন! সেই মসলার ঘ্রাণে পুরো বাড়ি ম ম করত আর প্রতিটি কাজে থাকত বরকত।

এখনকার পর্ব: "কই রে, ফুড প্রসেসরের ছোট বাটিটা কই? ইউটিউবে দেখলাম, এই নতুন অ্যারাবিয়ান কাবাবটা নাকি এয়ার ফ্রাইয়ারে দারুণ হয়!" হাতে এখন আর ব্যথা নেই, আছে শুধু সঠিক বাটনে চাপ দেওয়ার টেনশন। তবে সবচেয়ে সুন্দর পরিবর্তনটা হলো, রান্না শেষে খাবারের ছবি পোস্ট করার সময় ক্যাপশন শুরু হয় "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম" অথবা "আলহামদুলিল্লাহ" দিয়ে। খাবারের ছবিটাও যেন এখন একটা ইবাদত!

আগে স্বাদ, এখন ছবির অ্যাঙ্গেল—রান্নার চ্যালেঞ্জ এখন দ্বিগুণ!

আগে স্বাদ, এখন ছবির অ্যাঙ্গেল—রান্নার চ্যালেঞ্জ এখন দ্বিগুণ!

অধ্যায় ২: সিরিয়ালের ড্রামা থেকে ইসলামিক আলোচনার প্রশান্তি

আগের পর্ব: সন্ধ্যা মানেই ছিল পারিবারিক ড্রামা সিরিয়ালের রাজত্ব। সিরিয়ালের চরিত্রদের দুঃখে মায়ের চোখ ভিজে যেত, আর খলনায়িকাদের কর্মকাণ্ডে বসার ঘর উত্তপ্ত হয়ে উঠত।

এখনকার পর্ব: টিভির রিমোট এখন প্রায় অবসরে। মা এখন ড. জাকির নায়েক, মিজানুর রহমান আজহারী বা শায়খ আহমাদুল্লাহর লাইভ লেকচার শোনায় ব্যস্ত। রান্না করতে করতেও এখন প্লে হয় "প্রশ্নোত্তর পর্ব"। মাঝে মাঝে তো আমাদেরকেই ডেকে বলেন, "শোনো, শায়খ কী সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন! সুবহানাল্লাহ!" সিরিয়ালের কুটনামি থেকে মায়েদের এই ইসলামিক জ্ঞাণের দিকে ঝুঁকে পড়াটা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র এক বড় নিয়ামত।

অধ্যায় ৩: টেলিফোনের আলাপ থেকে ‘মাশাআল্লাহ’ কমেন্টের ঝড়

আগের পর্ব: পাশের বাড়ির আন্টি فون করে জিজ্ঞেস করতেন, "ভাবী, আজ কী রাঁধলেন?" রেসিপি দেওয়া-নেওয়া চলত মুখে মুখে।

এখনকার পর্ব: মা এখন রান্নার পর আগে আমাদের ডাকেন না, ডাকেন তার স্মার্টফোনকে। শুরু হয় ফটোসেশন। রান্না যেমনই হোক, ফেসবুক গ্রুপে ছবির অ্যাপ্রুভাল পাওয়াটাই এখন আসল চ্যালেঞ্জ। আর ছবির ক্যাপশন? "আজ দুপুরে সামান্য আয়োজন। আমার পরিবারের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ।" এরপর কমেন্ট বক্সে শুরু হয় "মাশাআল্লাহ", "আল্লাহ বরকত দিক", "রেসিপি প্লিজ" এর ঝড়। আর মা? রিপ্লাই দেন, "ইনবক্সে দিয়েছি বোন। জাযাকাল্লাহ খাইরান।"

অধ্যায় ৪: ডাক্তারের চেম্বার থেকে ইউটিউবের ‘সুন্নতি চিকিৎসা’

আগের পর্ব: সামান্য সর্দি-কাশিতেও ডাক্তারের কাছে দৌড়। তুলসী পাতা, মধু আর আদার রস ছিল প্রাথমিক চিকিৎসা।

এখনকার পর্ব: "ইউটিউবে দেখলাম, কালোজিরা আর মধু খেলে নাকি সব রোগের শেফা! হাদিসেও তো আছে।" এখন বাড়ির ছোটখাটো সব সমস্যার সমাধান হয় ইউটিউবের ইসলামিক স্কলারদের পরামর্শ আর "সুন্নতি চিকিৎসা" ভিডিও দেখে। মাঝে মাঝে তো আমাদেরকেই জ্ঞান দেন, "তোরা কী জানিস? বদনজর থেকে বাঁচতে অমুক দু'আটা পড়তে হয়। আমি আজই তোদের জন্য পড়ে ফুঁ দিয়েছি।"

উপসংহার: রূপান্তর, কিন্তু ঈমান আর ভালোবাসাটা একই

টেকনোলজি হয়তো আমাদের মায়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়েছে, তাদের রান্নাঘরে এনেছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। তারা হয়তো এখন আমাদের চেয়েও বেশি ডিজিটাল। কিন্তু একটা জিনিস আজও বদলায়নি—সেটা হলো তাদের ঈমান আর সন্তানের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।

রান্নাটা শিলনোড়ায় বাটা মসলার হোক বা এয়ার ফ্রাইয়ারে, "বিসমিল্লাহ" বলে শুরু করার বরকতটা একই থাকে। বিনোদনটা টিভি সিরিয়াল হোক বা ইসলামিক লেকচার, পরিবারের জন্য তাদের দু'আটা আগের মতোই আন্তরিক।

আসলে, আমাদের মায়েরা সময়ের সাথে নিজেদের বদলে নিয়েছেন, কারণ তারা সবসময় দ্বীন ও দুনিয়া দুটোই আগলে রাখতে চান। তাই পরেরবার যখন দেখবেন মা কোনো ইসলামিক পোস্ট শেয়ার করছেন, তখন রাগ না করে বরং একটা মুচকি হাসি দিন এবং বলুন, "আলহামদুলিল্লাহ"। কারণ এই ডিজিটাল দাইয়ি-র ভেতরে আপনার সেই জান্নাতি মা-ই তো লুকিয়ে আছেন।


এবার আপনার পালা!

আপনার মায়ের সাথেও কি এমন মজার কোনো ঘটনা ঘটেছে? টেকনোলজির কোন দিকটা তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন? নিচে কমেন্ট করে আমাদের জানান!

আর এই heartwarming লেখাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে আমাদের 'ডিজিটাল দাইয়ি' মায়েদের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন।

সম্পর্কিত আলোচনা পড়ুন

গানের তালে তালে ওয়াজ নাকি বিনোদন?

পোস্টটি পড়ুন

আমাদের ফলো করে পাশে থাকুন

নতুন পোস্ট প্রকাশের সাথে সাথে আপডেট পেতে আমাদের ফলো করুন।

ফলো করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ

নবীনতর পূর্বতন