হাশরের মাঠের সেই কঠিনতম তিনটি মুহূর্ত: আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরীর বয়ান থেকে শিক্ষা

হাশরের মাঠের ৩ মহাবিপদ - আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী

ভূমিকা

    আমরা মানুষের তৈরি একটি সাধারণ রেকর্ডিং যন্ত্র বা সিসিটিভি ক্যামেরাকে ভয় পাই, কারণ তাতে আমাদের প্রতিটি কথা ও অঙ্গভঙ্গি রেকর্ড হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেই মহান আল্লাহ নিযুক্ত ফেরেশতাদের রেকর্ডিং ব্যবস্থা কতটা নিখুঁত ও উন্নত? দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি ভালো ও মন্দ কাজের সেই নির্ভুল রেকর্ডের নামই হলো আমলনামা।

    আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা নুরুল ইসলাম সাহেব ওলিপুরী হুজুরের এই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে আমরা হাশরের মাঠের সেই কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে জানব, যা প্রতিটি মুমিনের অন্তরকে কাঁপিয়ে দেয়। Allama Nurul Islam Olipuri Saheber - এই Bangla Waz আমাদের পরকালের প্রস্তুতির কথা নতুন করে ভাবতে শেখায়।

    প্রথম মহাবিপদ: আমলনামা হাতে পাওয়ার মুহূর্ত

    হাশরের মাঠের তিনটি ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে প্রথমটি হলো আমলনামা হাতে পাওয়ার মুহূর্ত। আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী তাঁর আলোচনায় এই মুহূর্তটির ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, সেদিন মানুষ এতটাই আতঙ্কিত থাকবে যে, নিজের মা, বাবা, সন্তান ও সকল আত্মীয়-স্বজনকে ভুলে যাবে শুধু একটি চিন্তায়—আমার আমলনামা ডান হাতে আসবে, নাকি বাম হাতে?

    কুরআনের ঘোষণা:
    মহান আল্লাহ বলেন,

   

        فَيَوْمَئِذٍ لَّا يُسْأَلُ عَن ذَنبِهِ إِنسٌ وَلَا جَانٌّ
        "সেদিন মানুষ বা জিন কাউকেই তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে না।" (সূরা আর-রহমান: ৩৯)    

    এর অর্থ এই নয় যে, কোনো হিসাব হবে না। বরং অপরাধ এতটাই স্পষ্ট হবে যে, জিজ্ঞাসা করার আগেই তা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

    ডান হাতে আমলনামা:

    যাদের আমলনামা ডান হাতে আসবে, তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

   

        فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَيَقُولُ هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ
        "যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে, ‘নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখো’।" (সূরা আল-হাক্কাহ: ১৯)    

    আমলনামা হাতে পাওয়ার মুহূর্ত

    বাম হাতে আমলনামা ও পাপীদের অস্বীকার:

    আর যাদের আমলনামা বাম হাতে আসবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন পরিণতি এবং অপমান জনিত শাস্তি। নুরুল ইসলাম ওলিপুরী সাহেব যেমনটা বলেন, আল্লাহ তাদের জিজ্ঞাসা করবেন, "দুনিয়াতে কেন পাপ করেছিলে বল?" কিন্তু পাপিষ্ঠরা সরাসরি তাদের পাপ অস্বীকার করে বসবে।

    তখন আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে তিনটি অকাট্য প্রমাণ হাজির করবেন:

    ১. জমিনের সাক্ষ্য: জমিন নিজেই বলে দেবে, তার কোন অংশে বান্দা কোন পাপ করেছিল।
    ২. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য: আল্লাহ পাপীর মুখে মোহর মেরে দেবেন এবং তার হাত, পা, চোখ, কান—প্রত্যেকটি অঙ্গ তার দ্বারা সংঘটিত পাপের সাক্ষী দেবে।

   

        ٱلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَىٰٓ أَفْوَٰهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَآ أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا۟ يَكْسِبُونَ
        "আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে যা তারা অর্জন করত।" (সূরা ইয়াসিন: ৬৫)
        ৩. লিখিত আমলনামা: সবশেষে, ফেরেশতাদের হাতে লেখা আমলনামাটি তার সামনে পেশ করা হবে এবং বলা হবে, "পড়ো তোমার কিতাব!"    

    দোষারোপের পালা: বন্ধু, নেতা এবং শয়তান

    তিনটি প্রমাণ সামনে আসার পর পাপীরা আর নিজেদের পাপ অস্বীকার করতে পারবে না। তখন তারা নিজেদের বাঁচাতে অন্যদের দোষারোপ করতে শুরু করবে।

       
  • বন্ধুকে দোষারোপ: তারা বলবে, "হে আল্লাহ, আমি তো ভালোই ছিলাম, আমার খারাপ বন্ধুরা আমাকে বিপথগামী করেছে।"
  •    নেতাকে দোষারোপ: তারা বলবে, "আমার দলের নেতা বা নেত্রীর নির্দেশে আমি পাপ করেছি, তাদের ধরুন।" কিন্তু আল্লাহ বলবেন, "আমার বিধান লঙ্ঘন করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা হারাম।"
  •    শয়তানকে দোষারোপ: সবশেষে তারা শয়তানকে দোষ দেবে। কিন্তু শয়তান বলবে, "আমার তো কোনো ক্ষমতা ছিল না, আমি তো শুধু কুমন্ত্রণা দিয়েছি। দোষ আমার নয়, দোষ তার যে আমার কথা শুনেছে।"

    নিজস্ব প্রতিফলন (বর্তমান প্রেক্ষাপটে):
    আজ আমরা সোশ্যাল মিডিয়া বা বাস্তব জীবনে কার সাথে মিশছি? কোন নেতা বা আদর্শকে অনুসরণ করছি? আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরীর আলোচনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হাশরের মাঠে কেউ কারো দায় নেবে না। তাই দুনিয়াতেই আমাদের সঙ্গী নির্বাচন এবং আনুগত্যের সীমা নির্ধারণ করতে হবে।

    দ্বিতীয় মহাবিপদ: মিজান (আমলের ওজন)

    আমলনামা পাওয়ার পর যে দ্বিতীয় মহাবিপদের কথা আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী তুলে ধরেছেন, তা হলো মিজান বা আমল ওজন করার পাল্লা। সেদিন বান্দার ভালো ও মন্দ আমল ওজন করা হবে। মনে রাখতে হবে, আমলের পরিমাণ বেশি হলেই পাল্লা ভারী হবে না। নেকির পাল্লা ভারী হওয়ার ৩টি শর্ত রয়েছে:

    মিজান বা আমলের ওজন

    ১. ঈমান: আমলকারীর বিশুদ্ধ ঈমান থাকতে হবে।
    ২. সহীহ নিয়ত (ইখলাস): কাজটি শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়।
    ৩. নবীর তরীকা: আমলটি মনগড়া পদ্ধতিতে না করে, নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর দেখানো পথে বা সুন্নত অনুযায়ী করতে হবে। এই তিনটি শর্ত পূরণ হলে একটিমাত্র নেক আমলও পাহাড় পরিমাণ ইবাদতের চেয়ে ভারী হতে পারে।

    নিজস্ব প্রতিফলন (বর্তমান প্রেক্ষাপটে):
    আমরা কি আমাদের দান বা ইবাদতগুলো মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য করি? নাকি শুধুই আল্লাহর জন্য? ওলিপুরী হুজুরের আলোচনা অনুযায়ী, নিয়ত ছাড়া আমলের কোনো ওজন নেই।

    তৃতীয় মহাবিপদ: পুলসিরাত পার হওয়া

    জাহান্নামের উপর স্থাপিত চুলের চেয়েও চিকন এবং তরবারির চেয়েও ধারালো পুলসিরাত পার হওয়া হবে শেষ পরীক্ষা। দুনিয়ার কোনো শক্তি দিয়ে এই সেতু পার হওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র নেক আমলের শক্তিই সেদিন বান্দাকে পার হতে সাহায্য করবে।

    পুলসিরাত পার হওয়ার ভয়াবহতা

    হাদিসে এসেছে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, আর কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এই পুল পার হবে। যার আমল যেমন, তার পার হওয়ার গতিও হবে তেমন। আর পাপিষ্ঠরা পা ফসকে নিচে অবস্থিত জাহান্নামের ফুটন্ত পানিতে নিক্ষিপ্ত হবে।

    শেষ কথা

    আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী-এর এই শক্তিশালী আলোচনা থেকে আমরা পরকালের কঠিন বাস্তবতার একটি স্পষ্ট চিত্র পাই। হাশরের এই মহাবিপদের দিনে, যখন সবাই 'ইয়া নাফসি' বলে আর্তনাদ করবে, তখন একমাত্র আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর উম্মতের জন্য "ইয়া রাব্বি উম্মাতি" (হে আমার রব, আমার উম্মতকে বাঁচাও) বলে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন।

    এই মহাবিপদ থেকে বাঁচতে এবং জান্নাত লাভ করতে হলে দুনিয়াতে নবীর তরীকা মতো জীবনযাপন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

     মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন

আলোচনাটি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে এবং সম্মানিত বক্তা আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী-এর বলিষ্ঠ কণ্ঠে সরাসরি শুনতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।

                                                মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন       
           
           
                           
       
           
   

    আপনার জন্য করণীয় (Action Points):

  • আত্মসমালোচনা করুন: প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ৫ মিনিট ভাবুন, আজ সারাদিন আমার আমলনামায় কী লেখা হলো? কোনো পাপ হয়ে গেলে সাথে সাথে তওবা করে নিন। 
  • সৎ সঙ্গ নির্বাচন করুন: এমন বন্ধুদের সাথে চলুন, যারা আপনাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 
  • নিয়ত শুদ্ধ করুন: যেকোনো ভালো কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন—"আমি এটা কার জন্য করছি?"        
  • একটি সুন্নাহ আঁকড়ে ধরুন: প্রতিদিন রাসূল (ﷺ)-এর একটি ছোট সুন্নত জেনে নিন এবং তা আমল করার চেষ্টা করুন।         

     

    সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQ Section):

    প্রশ্ন ১: আমলনামায় লেখা পাপ কি মোছা সম্ভব?
    উত্তর: হ্যাঁ। আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে তওবা করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন।

    প্রশ্ন ২: মিজানের পাল্লা ভারী করার সবচেয়ে সহজ আমল কী?
    উত্তর: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, "দুটি বাক্য জবানে বলতে অতি সহজ এবং মিজানের পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। তা হলো: ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম’।" (বুখারি ও মুসলিম)

    প্রশ্ন ৩: আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরীর আলোচনা অনুযায়ী, পুলসিরাত পার হওয়ার মূল শক্তি কী?
    উত্তর: তাঁর আলোচনা এবং কুরআন-হাদিস অনুযায়ী, দুনিয়াতে আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) যে ব্যক্তি অটল থাকবে এবং নেক আমল করবে, তার জন্য আখেরাতের পুলসিরাত পার হওয়া সহজ হবে।

হাশরের মাঠের ৩ সময়ের মহাবিপদ: আল্লামা ওলিপুরীর আলোচনা থেকে শিক্ষা

   
           
  • ১. আমলনামা (📖): ডান হাতে পেলে সফলতা, বাম হাতে পেলে মহাবিপর্যয়। জমিন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও লিখিত রেকর্ড সাক্ষী দেবে।
  •        
  • ২. মিজান (⚖️): আমল ওজন করা হবে। নিয়ত ও সুন্নাহ ছাড়া আমল মূল্যহীন।
  •        
  • ৩. পুলসিরাত (🌉): চুলের চেয়ে চিকন, তরবারির চেয়ে ধারালো সেতু পার হওয়া। একমাত্র নেক আমলই হবে শক্তি।
  •        
  • বাঁচার উপায় (🤲): খাঁটি তওবা, সৎ সঙ্গ, শুদ্ধ নিয়ত এবং সুন্নাহর অনুসরণ।
  •    
   

সম্পর্কিত আলোচনা পড়ুন

   

        জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় এবং মুমিনদের জন্য জান্নাতের নেয়ামত সম্পর্কে আরও জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।    

    পোস্টটি পড়ুন

আমাদের ফলো করে পাশে থাকুন

নতুন পোস্ট প্রকাশের সাথে সাথে আপডেট পেতে আমাদের ফলো করুন।

ফলো করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ

নবীনতর পূর্বতন