
ভূমিকা
এই গভীর এবং ঈমানদীপ্ত আলোচনাটি উঠে এসেছে প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার মুফতি আবুল হাসান জকিগঞ্জী এর একটি অনবদ্য বয়ানে। তাঁর সেই মনোজ্ঞ বাংলা ওয়াজ মাহফিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আজ আমরা জানব আজান আবিষ্কার এর সেই অলৌকিক ও হৃদয়স্পর্শী ইতিহাস।
জামাতের গুরুত্ব ও একটি ঐশী আহ্বানের প্রয়োজন
ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানের সংখ্যা যখন সীমিত ছিল, তখন নামাজের সময় হলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা ছাড়াই একত্রিত হতেন। কিন্তু দিন দিন যখন ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ল এবং মুসলিম উম্মাহর পরিধি বাড়তে লাগল, তখন সবাইকে এক সময়ে জামাতে একত্রিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে জামাতের সেই ঐক্য, ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন এবং সাতাশ গুণ বেশি সওয়াব থেকে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছিলেন।
রাসূলের (ﷺ) পরামর্শ সভা: একটি স্বতন্ত্র আহ্বানের সন্ধান
উম্মতের এই সমস্যা সমাধানের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। Maulana Mufti Abul Hasan তার আলোচনায় সেই প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন:
- আগুন জ্বালানো: একজন সাহাবী প্রস্তাব দিলেন, নামাজের সময় হলে কোনো উঁচু টিলার উপর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু নবীজি (ﷺ) এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন, কারণ এটি অগ্নিপূজকদের রীতির সাথে মিলে যায়।
- ঘণ্টা বাজানো: আরেকজন পরামর্শ দিলেন গির্জার মতো ঘণ্টা বাজানোর জন্য। রাসূল (ﷺ) এটিও প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ এটি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আলামত।
- শিংগায় ফুঁ দেওয়া: ইহুদিদের মতো শিংগায় ফুঁ দেওয়ার প্রস্তাবও এলো। কিন্তু অন্য ধর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় এটিও গৃহীত হলো না।
- পতাকা ওড়ানো: শেষে পতাকা ওড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলো। নবীজি (ﷺ) বললেন, এতেও সকলে মনোযোগী নাও হতে পারে এবং কর্মব্যস্ত মানুষ তা খেয়াল করতে পারবে না।
ইসলামের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রতিটি প্রস্তাবই নাকচ করে দিলেন। তিনি চাইলেন এমন একটি ব্যবস্থা, যা হবে স্বতন্ত্র এবং আল্লাহর মহত্ত্বের পরিচায়ক। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে তিনি সবাইকে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে বললেন।
নিজস্ব প্রতিফলন: সুবহানাল্লাহ! এই ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ইসলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখতে কতটা যত্নশীল। রাসূলের (ﷺ) এই সিদ্ধান্ত আমাদের শেখায়, অন্যের অনুকরণ না করে আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি নিজেই সর্বোত্তম পথ দেখান। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও এই শিক্ষাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বপ্নের মাধ্যমে আজান আবিষ্কার: যেভাবে আসমান থেকে এলো সেই সুর
সাহাবায়ে কেরাম বাড়িতে ফিরলেন, কিন্তু তাদের অন্তরে রয়ে গেল এক গভীর ফিকির—কীভাবে উম্মাহকে নামাজের জন্য ডাকা যায়? এই চিন্তা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন জলিলুল কদর সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) সেই রাতে তিনি বাস্তব এক স্বপ্ন দেখলেন যে সপ্ন আজও রোজ ৫ বার সেই সপ্নের বাস্তব কন্ঠ শুনে থাকি।

তিনি ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি এক অবস্থায় দেখলেন, সবুজ পোশাক পরিহিত এক ফেরেশতা তাকে আজানের প্রতিটি বাক্য শিখিয়ে দিচ্ছেন: "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার..." থেকে শুরু করে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" পর্যন্ত। ঘুম থেকে জেগে তিনি দৌড়ে গেলেন রাসূলের (ﷺ) দরবারে। তাঁর স্বপ্নের কথা শুনে নবীজি (ﷺ) বললেন, "নিঃসন্দেহে এটি একটি সত্য স্বপ্ন।"
এইভাবেই কোনো মানুষের পরিকল্পনায় নয়, বরং সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্ধারিত হলো ইসলামের এই মহান আহ্বান। এই waz bangla থেকে আমরা জানতে পারি, আজান হলো এক ঐশী উপহার। নবীজি (ﷺ) হযরত বেলাল (রাঃ) কে এই বাক্যগুলো শিখিয়ে দিতে বললেন, কারণ তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সুউচ্চ ও মধুর। এভাবেই হযরত বেলালের (রাঃ) কণ্ঠে মদিনার আকাশে প্রথমবারের মতো ধ্বনিত হলো ইসলামের সুমহান আহ্বান।
আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম": ফজরের আজানের সেই বিশেষ সংযোজন
আজানের ইতিহাসে আরেকটি সুন্দর ঘটনা হলো ফজরের আজানে "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম" (ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম) বাক্যটি যুক্ত হওয়া। একদিন হযরত বেলাল (রাঃ) ফজরের আজান দিয়ে দেখলেন রাসূল (ﷺ) মসজিদে আসছেন না। তিনি নবীজির হুজরার পাশে গিয়ে "আস-সালাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ!" বলে ডাকতে লাগলেন। ভেতর থেকে উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রাঃ) জানালেন, "রাসূল (ﷺ) আরাম করছেন।"
তখন হযরত বেলাল (রাঃ) উচ্চস্বরে বললেন, "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।" এই কথা শুনে নবীজি (ﷺ) জেগে উঠলেন এবং বেলালের এই বাক্যটিকে খুব পছন্দ করলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, আজ থেকে ফজরের আজানে "হায়্যা আলাল ফালাহ" এর পরে এই বাক্যটি যোগ করে দিতে। এভাবেই এই বরকতময় বাক্যটি কিয়ামত পর্যন্ত ফজরের আজানের অংশ হয়ে গেল।
নবীজির ﷺ নির্বাচিত চার মুয়াজ্জিন ও বেলালের অমর প্রেম
এই Notun waz থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের জবানে চারজন সাহাবীকে মুয়াজ্জিনের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তারা হলেন:
- হযরত বেলাল হাবশী (রাঃ)
- হযরত আবু মাহযুরা (রাঃ)
- হযরত সাদ ইবনে কুরস (রাঃ)
- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ)
তাঁদের মধ্যে হযরত বেলাল (রাঃ) এর নবীপ্রেম ছিল কিংবদন্তিতুল্য। রাসূলের ﷺ ইন্তেকালের পর বেলাল (রাঃ) দুঃখে মদিনায় আর আজান দিতে পারতেন না, কারণ "আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ" বলার সময় নবীজিকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
নিজস্ব প্রতিফলন: হযরত বেলাল (রাঃ) এর এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সত্যিকারের নবীপ্রেম কাকে বলে। আজ আমরা কত সহজে দরুদ পড়ি, কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা কি বেলালের মতো এত গভীর? এই কাহিনী আমাদের রাসূলের (ﷺ) প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে এবং তাঁর সিরাত আরও বেশি করে অধ্যয়ন করতে উৎসাহিত করে।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
আল্লাহর দিকে আহ্বানের চেয়ে উত্তম কথা আর কী হতে পারে?
Mufti abul hasan এর ওয়াজ আমাদের শেখায়, আজান কেবল নামাজের জন্য একটি সাধারণ আহ্বান নয়, বরং এটি তাওহীদ ও রিসালাতের এক শ্বাশত ঘোষণা। এটি এমন এক আহ্বান, যার ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
"ওই ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং বলে, ‘নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’।"
- (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৩)
মুয়াজ্জিনেরা ঠিক সেই কাজটিই করেন। কেয়ামতের দিন তাদের মর্যাদা হবে অনেক উঁচু।
আজানের জন্মকথা: এক নজরে
সমস্যা ও পরামর্শ
মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ায় সবাইকে একত্রে নামাজের জন্য ডাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আগুন, ঘণ্টা বা পতাকার মতো বিভিন্ন প্রস্তাব বাতিল হয়।
ঐশী সমাধান: স্বপ্নযোগে আজান
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে আজানের বাক্যগুলো লাভ করেন।
ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন
রাসূল (ﷺ) হযরত বেলাল (রাঃ) কে তাঁর সুমধুর ও জোরালো কণ্ঠের জন্য প্রথম আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ফজরের বিশেষ সংযোজন
হযরত বেলাল (রাঃ) এর বলা "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম" বাক্যটি রাসূল (ﷺ) পছন্দ করেন এবং ফজরের আজানে যুক্ত করেন।
আজকের দিনে আমাদের করণীয়
আজানের এই সুন্দর ইতিহাস জানার পর আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে যা ঈমানকে আরও মজবুত করবে:
- আজানের জবাব দেওয়া: মুয়াজ্জিন যা বলেন, মনোযোগ দিয়ে শুনে তার সাথে সাথে বলা (হাইয়্যা আলাস সালাহ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ এর জবাবে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলা)।
- আজানের পর দোয়া পড়া: আজানের পর পঠিতব্য দোয়াটি শিখে নেওয়া এবং নিয়মিত পাঠ করা।
- মুয়াজ্জিনকে সম্মান করা: যিনি আমাদের কল্যাণের দিকে ডাকেন, তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা।
- নামাজের জন্য প্রস্তুতি: আজান শোনার সাথে সাথে দুনিয়াবী কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নামাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন ১: কেন হযরত বেলাল (রাঃ)-কেই প্রথম আজান দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল?
রাসূল (ﷺ) হযরত বেলাল (রাঃ)-কে তাঁর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত জোরালো, সুমধুর এবং দরাজ হওয়ার কারণে প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
প্রশ্ন ২: আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) ছাড়া আর কোনো সাহাবী কি আজানের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
হ্যাঁ, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সহ আরও কিছু সাহাবী প্রায় একই রকম স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা প্রমাণ করে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই ছিল।
প্রশ্ন ৩: আজানের মূল উদ্দেশ্য কী?
আজানের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর মহত্ত্ব ও একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়া, রাসূল (ﷺ) এর রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া এবং মানুষকে নামাজ ও সাফল্যের দিকে আহ্বান করা।