মা বাবার প্রতি সন্তানের হক: জান্নাত ও দুনিয়ার সফলতার চাবিকাঠি

মা বাবার প্রতি সন্তানের হক: জান্নাত ও দুনিয়ার সফলতার চাবিকাঠি

ভূমিকা

ইসলাম ধর্মে পারিবারিক বন্ধনকে এমন এক উচ্চাসনে স্থান দেওয়া হয়েছে, যা ইবাদতেরই অংশ। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের পরই যে সম্পর্কের স্থান, তা হলো মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কমা বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন করা কেবল সামাজিক শিষ্টাচার নয়, বরং এটি দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার চাবিকাঠি। সম্প্রতি প্রখ্যাত আলেম মুফতি গোলাম কিবরিয়া তাঁর এক নতুন ওয়াজ মাহফিলে এই বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা করেছেন, যা প্রতিটি সন্তানের জন্য এক অমূল্য পাথেয়। চলুন, সেই ইসলামি ওয়াজ এর আলোকে পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

আল্লাহর চোখে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল কোনটি?

যেকোনো ইসলামি ওয়াজ বা আলোচনার প্রাণকেন্দ্র হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একবার রাহমাতুল্লিল আলামিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল কোনটি?"

উত্তরে প্রিয়নবী (ﷺ) ক্রমানুসারে তিনটি শ্রেষ্ঠ আমলের কথা বলেন:

  1. সময়মতো নামাজ আদায় করা (আসসালাতু আলা ওয়াক্তিহা): আল্লাহর কাছে সবচেয়ে দামি এবং প্রথম আমল হলো নির্ধারিত সময়ে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা।
  2. মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করা (বিররুল ওয়ালিদাইন): দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আমল হলো মা বাবার সেবা করা, তাঁদের পাশে থাকা এবং খেদমত করা।
  3. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা (আল জিহাদু ফি সাবিলিল্লাহ): তৃতীয় হলো ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।

রেফারেন্স:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ سَأَلْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ قَالَ ‏"‏ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا ‏"‏‏.‏ قَالَ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ ‏"‏ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ ‏"‏‏.‏ قَالَ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ ‏"‏ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ‏"‏‏

অনুবাদ: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আল্লাহর কাছে কোন আমল সর্বাধিক প্রিয়?’ তিনি বললেন, ‘সময়মতো সালাত আদায় করা।’ আমি বললাম, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা।’ আমি বললাম, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’
(সহীহ আল-বুখারী, হাদিস নং ৫২৭)

নিজস্ব প্রতিফলন:

আজকের দ্রুতগতির জীবনে আমরা ক্যারিয়ার, পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের পেছনে ছুটতে গিয়ে প্রায়ই নামাজের সময় বা মা-বাবার খোঁজ নেওয়ার কথা ভুলে যাই। এই হাদিসটি আমাদের জীবনের অগ্রাধিকারগুলো নতুন করে সাজাতে সাহায্য করে। দুনিয়ার সফলতার আগে আল্লাহর হক এবং তারপরই মা-বাবার হক পূরণ করা আবশ্যক।

পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতেই রবের সন্তুষ্টি: জান্নাতের দুটি দরজা

Mufti Gulam Kibria তাঁর আলোচনায় তিরমিজি শরীফের একটি হাদিস তুলে ধরেন, যেখানে বলা হয়েছে, "রবের সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং রবের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।" এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার: যদি কোনো সন্তানের ওপর তার মা-বাবা সন্তুষ্ট থাকেন, তবে স্বয়ং আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন।

এই new bangla waz থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, পিতা-মাতা সন্তানের জন্য জান্নাতের দুটি খোলা দরজা। যে সন্তান প্রতিদিন তাঁর পিতা-মাতার সেবা ও যত্ন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের সেই দুটি দরজা খুলে দেন। যদি একজন জীবিত থাকেন, তবে একটি দরজা খোলা থাকে। এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে? এই আলোচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জান্নাত লাভের সহজ পথ আমাদের ঘরেই রয়েছে, যা Quran Sunnah দ্বারা প্রমাণিত।

নিজস্ব প্রতিফলন:

অনেক সময় মতের অমিলের কারণে আমাদের সাথে মা-বাবার দূরত্ব তৈরি হয়। আমরা ভুলে যাই যে, তাঁদের সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে আমাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা ও মঙ্গলকামনা। তাঁদের খুশি রাখার চেষ্টা করা মানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কোনো বিষয়ে দ্বিমত হলেও সম্মান ও ভালোবাসার সাথে তা সমাধান করা উচিত।

❗ সাবধান! মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া কবিরা গুনাহ

পিতা-মাতার খেদমত করা যেমন বড় সওয়াবের কাজ, ঠিক তেমনি তাঁদের কষ্ট দেওয়া বা নাফরমানি করা ইসলামে স্পষ্ট কবিরা গুনাহ। বুখারী শরীফের হাদিসে রাসূল (ﷺ) তিনটি সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন:

  মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া কবিরা গুনাহ
  • আল্লাহর সাথে শিরক করা: এটি সবচেয়ে বড় এবং ক্ষমার অযোগ্য পাপ।
  • মা-বাবার নাফরমানি করা: শিরকের পরেই মা বাবার অবাধ্যতাকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
  • মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া: যা মুনাফিকের অন্যতম আলামত।

এই islamic history থেকে আমরা শিক্ষা পাই, জীবনে চলার পথে এমন কোনো কাজ বা আচরণ করা উচিত নয়, যা তাঁদের অন্তরে সামান্যতম আঘাত হানে। প্রতিটি islamic channel এবং islamic video তে এই বিষয়ে সতর্ক করা হয়।

নিজস্ব প্রতিফলন:

আজকাল মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া শুধু অবাধ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তাঁদের ফোন না ধরা, মেসেজের উত্তর না দেওয়া, তাঁদের প্রয়োজনের সময় ব্যস্ততার অজুহাত দেখানো—এগুলোও এক ধরনের মানসিক কষ্ট। আমাদের আচরণ ও কথার মাধ্যমে যেন তাঁদের মনে সামান্যতম আঘাতও না লাগে, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিত।

যাদের মা-বাবা বেঁচে নেই, তাদের করণীয় কী?

এই waz mahfil-এর আলোচনায় একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় উঠে আসে। যাদের পিতা-মাতা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের জন্যও খেদমতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। ইসলামে এরও সুন্দর সমাধান রয়েছে। রাসূল (ﷺ) এমন সন্তানদের জন্য চারটি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন:

  1. তাঁদের জন্য সর্বদা দোয়া করা: আল্লাহর কাছে পিতা-মাতার জন্য দোয়া করা, যেন আল্লাহ তাঁদের কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দেন।
  2. ক্ষমা প্রার্থনা করা (ইস্তেগফার): আল্লাহর দরবারে তাঁদের গুনাহ মাফের জন্য ক্ষমা চাওয়া।
  3. তাঁদের প্রতিশ্রুতি ও ঋণ পূরণ করা: তাঁরা যদি কোনো ঋণ বা প্রতিশ্রুতি রেখে যান, তা সাধ্যমতো পূরণ করা।
  4. তাঁদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের সম্মান করা: পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক রাখা এবং তাঁদের সম্মান করা।

নিজস্ব প্রতিফলন:

মা-বাবা হারানোর কষ্ট অপূরণীয়, কিন্তু তাঁদের জন্য আমাদের করণীয় কখনো শেষ হয় না। তাঁদের পক্ষ থেকে একটি ছোট দান, তাঁদের নামে একটি গাছ লাগানো, অথবা প্রতি সালাতের পর তাঁদের জন্য দোয়া করা—এই ছোট ছোট আমলগুলোই মৃত্যুর পরেও তাঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখে।

এক নজরে মা-বাবার প্রতি সন্তানের হক

  • 🏆
    সর্বশ্রেষ্ঠ আমল: নামাজের পরেই মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল।
  • ❤️
    আল্লাহর সন্তুষ্টি: মা-বাবার সন্তুষ্টিতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। তাঁরা সন্তানের জন্য জান্নাতের দরজা।
  • ⚖️
    কবিরা গুনাহ: তাঁদের অবাধ্য হওয়া শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহগুলোর একটি।
  • 🤲
    মৃত্যুর পরেও করণীয়: দোয়া, ইস্তেগফার, ঋণ পরিশোধ এবং তাঁদের বন্ধুদের সম্মান করার মাধ্যমে হক আদায় করা যায়।
  • বরকত ও সফলতা: তাঁদের সেবা করলে আল্লাহ হায়াত, রিজিক ও সম্পদে বরকত দান করেন।

করণীয় তালিকা: আজ থেকেই শুরু করুন

  • ভাবুন এবং যোগাযোগ করুন: যদি দূরে থাকেন, প্রতিদিন অন্তত একবার ফোন করে মা-বাবার খোঁজ নিন এবং তাঁদের বলুন আপনি তাঁদের ভালোবাসেন।
  • দোয়া প্রার্থনা করুন: তাঁদের কাছে মন খুলে দোয়া চান। কারণ, সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া সরাসরি কবুল হয়।
  • ছোট উপহার দিন: তাঁদের পছন্দের কোনো ছোট জিনিস উপহার দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করুন। এর জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই, আপনার স্মরণই যথেষ্ট।
  • জ্ঞান ছড়িয়ে দিন: এই শিক্ষণীয় আলোচনাটি বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করুন, যেন তারাও এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • সাদাকায়ে জারিয়া করুন: যদি তাঁরা বেঁচে না থাকেন, তাঁদের নামে একটি সাদাকায়ে জারিয়া (যেমন: মসজিদে দান, বৃক্ষরোপণ) শুরু করুন, যার সওয়াব তাঁরা পেতেই থাকবেন।

মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন

সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)

প্রশ্ন ১: আমার মা-বাবা যদি অমুসলিম হন, তাহলেও কি তাঁদের সেবা করতে হবে?

উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই। তাঁদের ধর্ম যা-ই হোক না কেন, মা-বাবা হিসেবে তাঁদের সেবা করা, খেয়াল রাখা এবং দুনিয়াবী সকল বিষয়ে তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা আপনার ওপর ফরজ। তবে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোনো কাজে তাঁদের অনুসরণ করা যাবে না।

প্রশ্ন ২: আমি অনেক দূরে থাকি, কীভাবে তাঁদের খেদমত করব?

উত্তর: দূরে থেকেও খেদমত করা সম্ভব। যেমন: নিয়মিত ফোন করে emocional সাপোর্ট দেওয়া, তাঁদের আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করা, তাঁদের জন্য দোয়া করা এবং ছুটিতে তাঁদের সাথে সময় কাটানো।

প্রশ্ন ৩: যদি মা-বাবা কোনো অন্যায় দাবি করেন, তখন কী করব?

উত্তর: যদি তাঁদের দাবি শরীয়তবিরোধী হয়, তবে বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাঁদের সাথে অসম্মানজনক আচরণ করা যাবে না। ভালোবাসার সাথে নিজের অপারগতা বোঝাতে হবে।

সম্পর্কিত আরো একটি পোষ্ট পড়ুন

সুদের ভয়াবহ শাস্তি: যে পাপ মায়ের সাথে যিনার চেয়েও মারাত্মক

পোস্টটি পড়ুন

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, যে সন্তান মা বাবার প্রতি সন্তানের হক যথাযথভাবে আদায় করে, আল্লাহ তার হায়াতে, আমলে, রিজিকে এবং সম্পদে বরকত দান করেন। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে মা-বাবার খেদমত করে দুঃখী হয়েছে। পক্ষান্তরে, যে তাঁদের কষ্ট দিয়েছে, সে কখনো প্রকৃত সুখী হতে পারেনি।

সুতরাং, এই নতুন ওয়াজ থেকে শিক্ষা নিয়ে আসুন, আমরা আমাদের পিতা-মাতার সেবা করি, তাঁদের সম্মান করি এবং তাঁদের কাছ থেকে অন্তর থেকে দোয়া নিই, কারণ তাঁদের দোয়াই আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।


এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে সাদাকায়ে জারিয়ার অংশীদার হোন এবং এমন আরও ইসলামিক কন্টেন্ট পেতে আমাদের ব্লগটি সাবস্ক্রাইব করুন।

আমাদের ফলো করে পাশে থাকুন

নতুন পোস্ট প্রকাশের সাথে সাথে আপডেট পেতে আমাদের ফলো করুন।

ফলো করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ

নবীনতর পূর্বতন