
ভূমিকা
আমরা অনেকেই প্রয়োজনের তাগিদে লোন, কিস্তি বা বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, এই লেনদেনগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা 'সুদ' নামক ভয়ংকর পাপ আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কী পরিমাণ ধ্বংস ডেকে আনছে? সম্প্রতি এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী Bangla waz mahfil অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা মুফতি গোলাম কিবরিয়া কাসেমী সাহেব এই বিষয়ে কুরআন সুন্নাহর আলোকে যে আলোচনা করেছেন, তা প্রতিটি মুসলমানের অন্তরকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তাঁর এই ইসলামি ওয়াজ থেকে আমরা জানবো, কীভাবে এই নীরব ঘাতক একটি সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয় এবং কেন সুদকে ইসলামের অন্যতম ধ্বংসাত্মক মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়।
রাসূলের (ﷺ) অভিশাপ: শুধু সুদখোর নয়, জড়িত সবাই অভিশপ্ত
যেকোনো বাংলা ওয়াজ শুনলেই আমরা জানতে পারি যে, মহানবী (ﷺ) বিভিন্ন পাপের বিরুদ্ধে উম্মতকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেই ব্যক্তিদের ওপর অভিশাপ বা লানত দিয়েছেন যারা সুদের সাথে জড়িত। এই new waz থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে পারি, অভিশপ্তদের তালিকায় শুধু সুদ খোর ব্যক্তিই নেই, বরং চারটি শ্রেণি এর অন্তর্ভুক্ত:
- যে সুদ গ্রহণ করে।
- যে সুদ প্রদান করে।
- যে সুদের চুক্তিপত্র লেখে।
- এবং যে এই লেনদেনে সাক্ষী থাকে।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, পাপের ক্ষেত্রে এরা সবাই সমান। অর্থাৎ, সুদি কারবার একটি সম্মিলিত পাপ, যার দায় এর সাথে জড়িত প্রত্যেককে বহন করতে হবে।
হাদিসের রেফারেন্স:
عَنْ جَابِرٍ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُؤكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ
অনুবাদ: হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং এর সাক্ষীদ্বয়ের উপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং বলেছেন, (পাপের ক্ষেত্রে) তারা সকলেই সমান। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৯৮)
নিজস্ব প্রতিফলন:
আমরা অনেক সময় বন্ধু বা আত্মীয়কে সাহায্য করার নামে সুদি লোনের সাক্ষী হই বা ব্যবস্থা করে দেই। এই হাদিসটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সামান্য এই সহযোগিতাও আমাদের রাসূলের (ﷺ) অভিশাপের অংশীদার করে তুলতে পারে।
দুনিয়াবী গজব: দুর্ভিক্ষ, কাপুরুষতা এবং আল্লাহর আজাব
অনেকে মনে করেন, সুদের শাস্তি কেবল পরকালে। কিন্তু এই নিউ ওয়াজ আলোচনায় হাদিসের রেফারেন্সে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এর ভয়াবহ পরিণতি দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়।

- দুর্ভিক্ষ নেমে আসে: মুসনাদে আহমাদের হাদিস অনুযায়ী, যে সমাজে বা এলাকায় সুদের লেনদেন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট ও অভাব-অনটন দেখা দেয়।
- কাপুরুষের জন্ম হয়: যে সমাজে ঘুষের লেনদেন স্বাভাবিক হয়ে যায়, সেখানে কাপুরুষের জন্ম হয়। মানুষের ভেতর থেকে সাহস, নৈতিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে যায়।
- আল্লাহর আজাব: 'আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব' কিতাবের হাদিসে এসেছে, যখন কোনো সমাজে যিনা-ব্যভিচার এবং সুদের প্রচলন বেড়ে যায়, তখন সেই সমাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি আজাব বা গজবের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
নিজস্ব প্রতিফলন:
বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে তাকালে হাদিসের এই কথাগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, আমাদের সম্মিলিত পাপই কি এসব বিপর্যয়ের কারণ?
কল্পনাতীত পাপ: যে অপরাধ যিনার চেয়েও জঘন্য
এই islamic waz এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং চিন্তা উদ্রেককারী অংশ হলো সুদের পাপের ভয়াবহতার তুলনা, যা শুনলে যেকোনো ঈমানদারের অন্তর কেঁপে উঠবে।
- মায়ের সাথে যিনার চেয়েও জঘন্য: 'মুসতাদরাকে হাকেম'-এর হাদিস অনুযায়ী, সুদের ৭৩টি স্তর বা শাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন বা সবচেয়ে হালকা স্তরটি হলো "নিজের মায়ের সাথে যিনা করার সমান"। (নাউজুবিল্লাহ)।
- এক টাকায় ৩৬ বার যিনা: 'আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব'-এর আরেকটি হাদিসে এসেছে, কোনো ব্যক্তি যদি জেনে-বুঝে মাত্র এক টাকা সুদ খায়, তাহলে তার আমলনামায় ৩৬ বার যিনা করার পাপ লেখা হয়।
হাদিসের রেফারেন্স:
الرِبَا ثَلاثَةٌ وَسَبعُونَ بَابًا أَيسَرُهَا مِثلُ أَن يَنكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ
অনুবাদ: সুদের তেহাত্তরটি শাখা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে হালকা শাখাটি হলো কোনো ব্যক্তির তার নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করার মতো। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস: ২২৩৯)
নিজস্ব প্রতিফলন:
আধুনিক ব্যাংকিং এবং এনজিও সিস্টেম আমাদের সুদকে 'সার্ভিস চার্জ' বা 'মুনাফা'র মতো সুন্দর নামে পরিচিত করিয়েছে। কিন্তু নাম বদলালেই কি পাপের ভয়াবহতা কমে যায়? এই হাদিস আমাদের সেই বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনে।
পরকালের কঠিন শাস্তি: পাগল, বিকৃত এবং জাহান্নামের সাপ
- পাগল অবস্থায় পুনরুত্থান: তাফসীরে ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, কিয়ামতের দিন সুদখোরদেরকে পাগল বা উন্মাদ অবস্থায় উঠানো হবে, যা হবে চরম অপমানজনক।
- পেটের ভেতর সাপ: 'সুনানে ইবনে মাজাহ' শরীফের হাদিসে রাসূল (ﷺ) তাঁর মেরাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি জাহান্নামে এমন কিছু লোককে দেখেছেন যাদের পেট ঘরের মতো বিশাল এবং তা বিষাক্ত সাপে ভর্তি। সাপগুলো অনবরত তাদের পেটের ভেতর থেকে দংশন করছিল। জিব্রাইল (আঃ) জানান যে, এরাই হলো দুনিয়ার সুদখোর সম্প্রদায়। এমন আলোচনা বিভিন্ন islamic video তেও দেখা যায়, যা আমাদের জন্য এক বিরাট সতর্কবার্তা।

এই আলোচনা থেকে আমাদের করণীয়:
- নিজের সকল আর্থিক লেনদেন যাচাই করে দেখা এবং সুদের সাথে সামান্যতম সম্পর্ক থাকলে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা।
- অতীতের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে খাঁটি দিলে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে এমন পাপ না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
- সুদের বিকল্প হিসেবে ইসলামিক ব্যাংকিং এবং হালাল ব্যবসায়িক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
- পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এই পোস্টটি শেয়ার করে সদকায়ে জারিয়ার অংশীদার হওয়া।
- অল্পে তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে হালাল উপার্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
এক নজরে আলোচনার সারমর্ম
- 🚫 অভিশাপ: সুদদাতা, গ্রহীতা, লেখক ও সাক্ষী—সবাই রাসূল (ﷺ) এর অভিশাপ প্রাপ্ত।
- 📉 দুনিয়াবী গজব: সমাজে দুর্ভিক্ষ, অভাব এবং নৈতিক অবক্ষয় (কাপুরুষতা) নিয়ে আসে।
- 💔 মারাত্মক পাপ: সর্বনিম্ন পাপটি নিজের মায়ের সাথে যিনা করার সমান। এক টাকা সুদ ৩৬ বার যিনার পাপের সমান।
- 🔥 পরকালীন শাস্তি: পাগল অবস্থায় পুনরুত্থান এবং জাহান্নামে পেটের ভেতর সাপের যন্ত্রণাদায়ক দংশন।
- ⛔ জান্নাত হারাম: সুদখোর সেই ৪ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন: জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে সুদভিত্তিক লোন নেওয়া কি জায়েজ?
উত্তর: ইসলামে জীবনের চরম প্রয়োজনে (যেখানে জীবননাশের আশঙ্কা থাকে এবং কোনো হালাল বিকল্প নেই) হারাম জিনিস সাময়িকভাবে বৈধ হতে পারে। তবে এটিকে সাধারণ নিয়ম বানানো যাবে না এবং এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ করা আবশ্যক।
প্রশ্ন: ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা কি হারাম?
উত্তর: ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা নিজে হারাম নয়, যদি আপনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরো বিল পরিশোধ করে দেন এবং কোনো সুদ বা লেট ফি না আসে। হারাম হলো সুদের ফাঁদে পড়া। তাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি।
প্রশ্ন: ইসলামিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা কি সুদের অন্তর্ভুক্ত?
উত্তর: শরীয়াহভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্ব (মুদারাবা, মুশারাকা) বা ক্রয়-বিক্রয়ের (মুরাবাহা) মতো পদ্ধতিতে ব্যবসা করে। যদি তারা সঠিকভাবে শরীয়াহর নীতিমালা মেনে চলে, তবে তাদের মুনাফা সুদ হিসেবে গণ্য হবে না।