
ভূমিকা
ইসলামী জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তার মধ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ অন্যতম। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি আন্দোলন, একটি বিপ্লব এবং বাতিলের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতীক। সম্প্রতি প্রখ্যাত আলেম নুরুল ইসলাম খান সাহেব সুনামগঞ্জী তার এক মনোমুগ্ধকর waz mahfil-এ দেওবন্দ মাদ্রাসার ইতিহাস তুলে ধরেছেন, যা অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে।
তাঁর সেই new waz আলোচনার উপর ভিত্তি করেই আজকের এই লেখা। চলুন, সেই ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করা যাক, যা যে কোনো মুমিনের ঈমানকে শাণিত করবে।
১. কুরআনের জন্য আত্মত্যাগ: এক অবিস্মরণীয় সূচনা
দারুল উলুম দেওবন্দের চেতনা একদিনে তৈরি হয়নি। এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে রক্ত ও আত্মত্যাগের উপর। নুরুল ইসলাম খান সুনামগঞ্জ তার আলোচনায় বলেন, দারুল উলুম দেওবন্দের আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে ‘কুরআন জ্বালাও’ কর্মসূচি হাতে নেয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল দেওবন্দের পূর্বসূরিরা—একদল কচি-কাঁচা হাফেজে কুরআন।
ঘটনাটি ছিল হৃদয়বিদারক। ইংরেজ সিপাহীরা যখন লক্ষ লক্ষ কুরআন শরীফ জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছিল, তখন একটি ছোট হিফজ মাদ্রাসার ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, "আমরা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাব, কিন্তু আল্লাহর কালাম জ্বালাতে দেব না।"
তাদের ওস্তাদের বিচক্ষণতায়, ছাত্ররা মেহমান ইংরেজ সিপাহীদের সামনে সুমধুর কণ্ঠে পুরো ৩০ পারা কুরআন মুখস্থ শুনিয়ে দেয়। এই দৃশ্য ইংরেজদের স্তম্ভিত করে দেয়। তারা উপলব্ধি করে, কাগজের কুরআন পুড়িয়ে ইসলামকে ধ্বংস করা যাবে না, কারণ এই ঐশী গ্রন্থ লক্ষ লক্ষ মুসলমানের কলবে সংরক্ষিত আছে।
নিজস্ব প্রতিফলন:
এই ঘটনাটি আমাদের শেখায় যে, ঈমানের শক্তি বয়স বা শারীরিক সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে না। আল্লাহর কালামের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কচি শিশুরাও এমন পাহাড়সম দৃঢ়তার অধিকারী হতে পারে, যা বিশ্বের বড় বড় শক্তিকেও নতজানু করতে বাধ্য করে।
deobonder-itihas-o-songramকুরআনের হেফাজত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ
অনুবাদ: "নিশ্চয় আমিই এই যিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।" (সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯)
২. সংগ্রামের নতুন অধ্যায়: শামলীর দুর্গ থেকে প্রতিরোধ
এই ঘটনার পর ইংরেজরা তাদের কৌশল বদলায়। তারা কুরআন জ্বালানোর বদলে ‘কুরআনওয়ালাদের’ ধ্বংস করার মিশনে নামে। ঠিক তখনই দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা কাসেম নানুতুবী (রহ.), রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এবং হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-এর মতো শীর্ষ আলেমরা সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেন।

তাঁদের লড়াই শুরু হয় শামলীর দুর্গ থেকে, যা ছিল ইংরেজদের সবচেয়ে সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোর একটি। হাফেজ জামিন শহীদ (রহ.) ও রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর নেতৃত্বে প্রথম আঘাতেই সেই দুর্গের পতন ঘটে। এই islamic waz থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁরা হালুয়া-রুটি খাওয়া আলেম ছিলেন না, বরং বাতিলের বিরুদ্ধে ময়দানে লড়াকু সৈনিক ছিলেন।
৩. ইলমের সাগর: জ্ঞানের জগতে বিস্ময়কর প্রতিভা
দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা শুধু সংগ্রামী আলেমই তৈরি করেনি, তৈরি করেছে ইলমের এমন সব সাগর, যাদের জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তিতুল্য।
- আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.): তিনি তার সাথী, বাংলাদেশের কক্সবাজারের সন্তান মুহাম্মদ ইয়ামিন (রহ.)-এর সাথে প্রতিযোগিতা করে মাত্র এক মাসের মধ্যে পুরো বুখারী শরীফ মুখস্থ করে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাইখ তাঁর জ্ঞান দেখে মন্তব্য করেছিলেন, "আমি ভেবেছিলাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) মারা গেছেন, কিন্তু আজ দেখলাম তিনি কাশ্মীরীর সুরতে এখনো জীবিত।"
- শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.): তিনি শুধু হাফিজুল হাদিসই ছিলেন না, বরং ছিলেন ‘হাফিজুল উলুম’ বা সকল জ্ঞানের হাফেজ। নবী কারীম (ﷺ) স্বয়ং তাঁকে স্বপ্নে ইলমের এই সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
৪. রুহানিয়াতের সর্বোচ্চ শিখর ও ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর অনুসরণ
দেওবন্দী আলেমগণ শুধুমাত্র জ্ঞান বা সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, আধ্যাত্মিকতার জগতেও ছিলেন অনন্য। যেমনটা খান সাহেব তার waz bangla আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের এক সম্রাট। তিনি স্বপ্নযোগে সরাসরি নবী (ﷺ)-এর কাছ থেকে ইলমের ভাণ্ডার লাভ করেছিলেন।
দেওবন্দের আলেমরা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী। নুরুল ইসলাম খান তার sylheti waz-এ বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) স্বপ্নযোগে নবী (ﷺ) কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার মাযহাব প্রকাশ করেছিলেন। আজও বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান সেই পথ অনুসরণ করে, এবং দেওবন্দ সেই আদর্শকেই আঁকড়ে ধরে আছে।
এক নজরে আলোচনার সারমর্ম
📜 আত্মত্যাগ: কুরআনের সম্মান রক্ষায় কচিকাঁচাদের জীবন বাজি রাখার ঈমানী দৃঢ়তা।
⚔️ সংগ্রাম: ইংরেজদের বিরুদ্ধে শামলীর দুর্গের মতো সুরক্ষিত ঘাঁটিতে সশস্ত্র প্রতিরোধ।
🧠 জ্ঞান: আনোয়ার শাহ কাশ্মীরীর মতো কিংবদন্তিতুল্য মুহাদ্দিস তৈরি, যারা এক মাসে বুখারী শরীফ মুখস্থ করতেন।
✨ রুহানিয়াত: হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর মতো আধ্যাত্মিক সম্রাট, যারা সরাসরি নবী (ﷺ)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন।
🕋 আদর্শ: ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাযহাবের একনিষ্ঠ অনুসরণ।
এই আলোচনা থেকে আমাদের করণীয়:
- ✅ ইসলামের সঠিক ইতিহাস, বিশেষ করে দেওবন্দ মাদ্রাসার ইতিহাস সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
- ✅ নিজেদের সন্তানদের হাফেজে কুরআন বানানোর পাশাপাশি দ্বীনের সঠিক বুঝসম্পন্ন আলেম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
- ✅ বাতিলের সামনে ঈমানী দৃঢ়তা প্রদর্শন করা এবং কোনো পরিস্থিতিতেই সত্য বলা থেকে বিরত না থাকা।
- ✅ ইলমের কদর করা এবং হক্কানী আলেম-উলামাদের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করা।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন: দারুল উলুম দেওবন্দের আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: আল্লামা নুরুল ইসলাম খান সাহেবের আলোচনা অনুযায়ী, দারুল উলুম দেওবন্দের আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্বয়ং নবী কারীম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)।
প্রশ্ন: দেওবন্দের আলেমরা কেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন?
উত্তর: ইংরেজরা যখন ‘কুরআন জ্বালাও’ মিশনে ব্যর্থ হয়ে "কুরআনওয়ালাদেরকে ধ্বংস করো" নীতি গ্রহণ করে এবং আলেমদের উপর নির্যাতন শুরু করে, তখন নিজেদের ঈমান, দ্বীন এবং দেশ রক্ষার জন্য তাঁরা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রশ্ন: আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-কে কেন ইবনে হাজার আসকালানীর সাথে তুলনা করা হয়েছিল?
উত্তর: তাঁর ইলম, প্রজ্ঞা এবং হাদিসের উপর অসামান্য দক্ষতার কারণে। জামিয়া আল-আজহারের শাইখ তাঁর আরবি ভাষায় দেওয়া বুখারীর দরস শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাকে দ্বিতীয় ইবনে হাজার আসকালানী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
উপসংহার
দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস শুধু একটি মাদ্রাসার ইতিহাস নয়, এটি ঈমান, আত্মত্যাগ, গভীর জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার এক সম্মিলিত উপাখ্যান। নুরুল ইসলাম খান-এর মতো আলেমদের waz mahfil আমাদের সেই গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই আলোচনাগুলো বিভিন্ন famous islamic channel-এ পাওয়া যায় এবং প্রতিটি islamic video আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আল্লাহ তায়ালা দেওবন্দের এই ধারাকে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। আমিন।