
ভূমিকা
আমরা সবাই যেন এক অন্তহীন যাত্রার পথিক। এই ছুটে চলা জীবনে অর্থ, সম্পদ, পরিবার—সবকিছু থাকার পরেও মনের গভীরে কি কখনো এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেছেন? জীবনে বরকতের অভাব, সংসারে অশান্তি আর মানসিক অস্থিরতা কেন আমাদের নিত্যসঙ্গী? বর্তমান সময়ে আমরা এমন একটি নতুন সমাধান খুঁজছি যা আমাদের আত্মাকে প্রশান্তি দেবে এবং সঠিক পথের দিশা দেবে। এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই আলোচনা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্বারী ও বিশ্বজয়ী বক্তা হাফেজ নাজমুস সাকিব। তার সুললিত কন্ঠের কোরআন তেলাওয়াত যেমন মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তেমনি তার একটি বাংলা ওয়াজ মাহফিলের আলোচনা আমাদের চিন্তার জগতে নাড়া দিয়ে যায়।
আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য: কেবলই আল্লাহর ইবাদত
আলোচনার শুরুতে হাফেজ নাজমুস সাকিব পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
অনুবাদ: “আমি জিন এবং মানুষকে আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)
এই একটি আয়াতই আমাদের জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দুনিয়ার মোহে এতটাই ডুবে গেছি যে, এই মূল উদ্দেশ্য থেকেই গাফেল। অর্থ, সম্পদ আর খ্যাতির পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ করার ফুরসতটুকুও পাচ্ছি না। হাফিজ নাজমুস সাকিব তার ওয়াজ -এ তুলে ধরেন, আমাদের উচিত সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দেখানো পথে চলা, যাতে এই ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে আমরা আল্লাহর পুরস্কার হিসেবে জান্নাত লাভ করতে পারি।
নিজস্ব প্রতিফলন:
আমরা আমাদের ক্যারিয়ার, সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণে অবিরাম ছুটে চলি। কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে কি আমরা একবারও থামি নিজেদের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে? আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ কি আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যখন আমরা এই মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হই, তখনই অর্থহীনতা ও অপূর্ণতা আমাদের জীবনকে গ্রাস করে।
আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার ভয়াবহ পরিণতি

যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভুলে যায়, তার জীবন সংকীর্ণ হয়ে যায়। বাহ্যিকভাবে প্রাচুর্য থাকলেও তার অন্তরে শান্তি থাকে না, আয়-ইনকামে বরকত থাকে না এবং জীবনটা একটা অতৃপ্তির কারাগারে পরিণত হয়। এই প্রসঙ্গে কোরআনের এক ভয়াবহ চিত্র তিনি তুলে ধরেন:
وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ
অনুবাদ: “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য রয়েছে এক সংকীর্ণ জীবন এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাব।” (সূরা ত্বহা: ১২৪)
কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে ওই ব্যক্তি আল্লাহকে প্রশ্ন করবে:
قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنتُ بَصِيرًا
অনুবাদ: “হে আমার রব, কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন, অথচ আমি তো দুনিয়াতে দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ছিলাম?” (সূরা ত্বহা: ১২৫)
আল্লাহর জবাব হবে আরও কঠিন। তিনি বলবেন:
قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ
অনুবাদ: “এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াত এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আর সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো।” (সূরা ত্বহা: ১২৬)
একবার ভাবুন, সেই কঠিন দিনে যদি স্বয়ং আল্লাহ আমাদের ভুলে যান, তাহলে আমাদের আশ্রয়স্থল কোথায় হবে? এই বাংলা ওয়াজ ভিডিও (কথার মূলভাব) আমাদের সেই ভয়াবহ পরিণামের কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
নিজস্ব প্রতিফলন:
আমরা প্রায়শই পার্থিব ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, কিন্তু আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি উপেক্ষা করি। মানসিক অস্থিরতা, পারিবারিক কলহ এবং আয়-রোজগারে বরকতের অভাব—এগুলো সবই আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকার ফল হতে পারে। এই আয়াতে আমাদের জন্য এক গভীর সতর্কবাণী রয়েছে, যা আমাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ করে দেয়।
শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ
তাহলে এই গাফিলতির জীবন থেকে মুক্তির উপায় কী? হাফেজ নাজমুস সাকিব বলেন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে বরকত ও শান্তি লাভের মূল চাবিকাঠি হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। যে ব্যক্তি ফজরের নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করে, আল্লাহ স্বয়ং তার সারাদিনের রিজিক এবং সকল বিষয়ের জিম্মাদার হয়ে যান।

নামাজ শুধু একটি ইবাদতই নয়, এটি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও শান্তি নিয়ে আসে। যে ব্যক্তি আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদা করে, আল্লাহ তার স্ত্রী, সন্তান এবং সংসারে বরকত দান করেন। পরিবারে অশান্তি ও সন্তানের অবাধ্যতার মূল কারণ হলো আমরা আল্লাহর হুকুম মানি না।
নিজস্ব প্রতিফলন:
আধুনিক জীবনে সময় স্বল্পতার অজুহাতে আমরা নামাজকে অবহেলা করি। অথচ নামাজই আমাদের সকল অস্থিরতা দূর করে মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। এটি কেবল আল্লাহর প্রতি আমাদের দায়িত্বই নয়, বরং নিজেদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে বরকত আনার এক কার্যকরী উপায়। আসুন, নামাজের প্রতি মনোযোগী হই এবং এর মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করি।
উদ্ধার বা মুক্তির একমাত্র পথ: নবীর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা
কেয়ামতের দিন যখন সবাই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করবে, তখন আমাদের একমাত্র আশার আলো হবেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)। কিন্তু সেই শাফায়াত পাওয়ার জন্য আমাদের জীবনে নবীর সুন্নতের প্রতিফলন থাকতে হবে। যার জীবনে নবীর সুন্নতের রং যত বেশি, সে আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয়।
পোশাক, কথাবার্তা, হাঁটাচলা—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। আমরা সেই নবীর উম্মত, যিনি জীবনের শেষ মুহূর্তেও নিজের পরিবার বা সন্তানের কথা না ভেবে উম্মতের জন্য কেঁদেছেন। জিব্রাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করেছেন, "আমার পরে আমার উম্মতের কী হবে?" এমন দয়াময় নবীর আদর্শকে ভুলে যাওয়া আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের। প্রতিটি ইসলামিক ওয়াজ বা ইসলামিক চ্যানেল থেকে আমাদের এই শিক্ষাই গ্রহণ করা উচিত।
নিজস্ব প্রতিফলন:
ফ্যাশন এবং আধুনিকতার নামে আমরা প্রায়শই সুন্নতের বিপরীত পথে চলি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের পর আখেরাতে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো নবীর (ﷺ) আদর্শকে অনুসরণ করা। তাঁর সুন্নত আমাদের জন্য কেবল একটি জীবনপদ্ধতিই নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এক নিশ্চিত পথ।
জীবনের অপূর্ণতা ও অশান্তি থেকে মুক্তির সারসংক্ষেপ
- 🎯 সৃষ্টির উদ্দেশ্য: জিন ও মানুষকে কেবল আল্লাহর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
- 🚫 বিমুখতার পরিণতি: আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সংকীর্ণ জীবন ও কেয়ামতের দিন অন্ধত্ব।
- 🔑 শান্তির চাবিকাঠি: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জীবনে বরকত ও মানসিক শান্তি এনে দেয়।
- 💡 মুক্তির পথ: নবীর (ﷺ) সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা আখেরাতে শাফায়াত লাভের উপায়।
- 🤲 করণীয়: আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, নামাজ ও সুন্নতের অনুসরণ।
আমাদের করণীয়
বাংলা ওয়াজ এর এই আলোচনা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হলো, দুনিয়ার যেকোনো প্রয়োজনে বা বিপদে আমরা যেন সবার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই। কারণ তিনিই একমাত্র দাতা এবং তাঁর কাছে চাইলে তিনি কখনো ফিরিয়ে দেন না।
আসুন, আমরা সকলে প্রতিজ্ঞা করি যে, আজ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করব এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে জীবনকে সুন্নতের রঙে রাঙিয়ে তুলব। এমন আরও অনেক ইসলামিক ভিডিও এবং বাংলাদেশি ওয়াজ শুনে আমরা যেন নিজেদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের জন্য কবুল করুন। আমিন।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
আমাদের দায়িত্ব ও আমানত
আলোচনার শেষে হাফেজ নাজমুস সাকিব বলেন, দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসাগুলো আমাদের কাছে আমানত। এই আমানত রক্ষা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। হযরত আবু বকর (রাঃ) যেমন যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, তেমনি আমাদেরও দ্বীনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
এই বাংলা ওয়াজ টি শুধু একটি আলোচনাই নয়, বরং এটি আমাদের ঈমানকে জাগিয়ে তোলার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আপনি যদি এমন আরও আলোচনা শুনতে চান, তবে আমাদের Famous islamic channel এ চোখ রাখতে পারেন।
করণীয় তালিকা: আজ থেকেই শুরু করুন
- কোরআন পাঠের অভ্যাস করুন: প্রতিদিন অন্তত একটি আয়াত অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ পড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। এর জন্য ভালো কোনো অ্যাপ বা তাফসির গ্রন্থের সাহায্য নিতে পারেন।
- ঈমানকে নবায়ন করুন: প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করুন, "আমার আজকের কাজগুলোর উদ্দেশ্য কি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ছিল?" যদি না থাকে, তবে নিয়তকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।
- আলেমদের সাহচর্যে থাকুন: স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা কোনো বিশ্বস্ত আলেমের আলোচনা নিয়মিত শুনুন। তাদের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করুন, কারণ ভালো সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোচনা ঈমানকে সতেজ রাখে।
- দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করুন: আপনার সময়, মেধা বা হালাল উপার্জন থেকে সামান্য অংশ দিয়ে নিকটস্থ কোনো মাদ্রাসা বা ইসলামি কেন্দ্রকে সাহায্য করুন। এটি একটি সদকায়ে জারিয়া।
সম্পর্কিত আরো একটি পোষ্ট পড়ুন
জানাজার নামাজ কি দোয়া? হযরত আলীর তলোয়ারের দর্শন থেকে সিরাতে মুস্তাকিমের শিক্ষা
পোস্টটি পড়ুনসাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন: ঈমান শক্তিশালী করার সবচেয়ে সহজ উপায় কী?
উত্তর: ঈমান বাড়ে ও কমে। একে শক্তিশালী করার সহজ উপায় হলো আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করা (অর্থসহ), জিকির করা এবং সৎ সঙ্গে থাকা। পাশাপাশি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ঈমানকে মজবুত করে।
প্রশ্ন: আমি আলেম নই, কোরআনের জ্ঞান কীভাবে আমার মর্যাদা বাড়াবে?
উত্তর: কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা শুধু আলেমদের জন্য ফরজ নয়। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। আপনি যখন কোরআন থেকে জীবনের দিকনির্দেশনা নেবেন এবং সে অনুযায়ী আমল করবেন, তখন আপনার প্রজ্ঞা, চরিত্র ও কর্ম আল্লাহর কাছে প্রিয় হবে, যা আপনার মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।
প্রশ্ন: ব্যস্ত জীবনে দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করার মতো সময় পাই না, করণীয় কী?
উত্তর: সাহায্য শুধু অর্থ বা সময় দিয়ে হয় না। আপনি আপনার পরিচিত মহলে কোনো মাদ্রাসার জন্য প্রচার করতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ভালো কাজগুলো শেয়ার করতে পারেন অথবা তাদের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করতে পারেন। আপনার সামান্য চেষ্টাই আল্লাহর কাছে অনেক বড় প্রতিদান বয়ে আনতে পারে।