
ইসলাম আমাদের শান্তি ও হেদায়েতের পথ দেখায়, আর এই পথের প্রধান আলোকবর্তিকা হলো মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এমন একটি অবিশ্বাস্য ও হৃদয়স্পর্শী ঘটনা নিয়েই আজকের আলোচনা, যা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানকে নাড়া দেবে। সম্প্রতি প্রখ্যাত আলেম ও জনপ্রিয় বক্তা মাওলানা সিরাজুল ইসলাম দারুলহুদা তাঁর এক বয়ানে এমনই এক অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরেছেন, যা শুধু একটি গল্প নয়, বরং এটি মহান আল্লাহর অসীম রহমত এবং কোরআনের প্রতি এক সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার এক জীবন্ত নিদর্শন। আসুন, সেই ঈমানদীপ্ত কাহিনীতে ডুব দেওয়া যাক।
ধর্মজ্ঞানহীন জনপদে এক নিরক্ষর কোরআন প্রেমিক
ঘটনাটি হিন্দুস্তানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের। গ্রামটি এতটাই ধর্মীয় জ্ঞান থেকে দূরে ছিল যে, সেখানকার মানুষ নামাজ তো দূরের কথা, কেউ মারা গেলে তার গোসল, জানাজা বা দাফন-কাফনের মতো আবশ্যকীয় বিষয়গুলোও জানত না। এমন এক ইসলামি জ্ঞানশূন্য সমাজে বাস করতেন আল্লাহর এক গরিব বান্দা, একজন সাধারণ দিনমজুর। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআন পড়তে জানতেন না, একটি অক্ষরও চিনতেন না।
কিন্তু বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল থেকে তিনি আলেমদের মুখে কোরআনের সম্মান, মর্যাদা ও ইজ্জতের কথা শুনেছিলেন। সেই কথাগুলো তাঁর অন্তরে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, কোরআনের প্রতি তাঁর কলিজায় এক গভীর ও তীব্র ভালোবাসা জন্মায়। সেই ভালোবাসা থেকেই তিনি একটি কোরআন শরিফ কিনে আনেন।
নিজস্ব প্রতিফলন:
আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের হাতের মুঠোয় কোরআনের অগণিত অ্যাপস, তাফসির ও রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও আমরা কতজন এর মর্যাদা উপলব্ধি করি? এই নিরক্ষর মানুষটির গল্প আমাদের শেখায়, জ্ঞান বা সম্পদের প্রাচুর্যের চেয়েও আল্লাহর কাছে অন্তরের খাঁটি ভালোবাসা অনেক বেশি মূল্যবান।
এক অশ্রুসিক্ত ইবাদত: যা ছিল তাঁর প্রতিদিনের আমল
তেলাওয়াত করতে না পারলেও তাঁর আমল ছিল বিস্ময়কর। প্রতিদিন ফজরের পর পবিত্র হয়ে তিনি পরম যত্নে কাপড়ে মোড়ানো কোরআনটি খুলতেন। এরপর প্রতিটি পৃষ্ঠার লাইনে লাইনে তাঁর আঙ্গুল বুলিয়ে যেতেন এবং অশ্রুসিক্ত চোখে কম্পিত কণ্ঠে বলতেন:
"আমার মালিক এখানে যা বলেছেন, সব সত্য বলেছেন।"
এই ছিল তাঁর প্রতিদিনের ইবাদত, তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত একনিষ্ঠ সাক্ষ্য। এই কাজটি বাহ্যিকভাবে ছোট মনে হলেও এর পেছনে ছিল আল্লাহর কালামের প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
অনুবাদ: “নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল, আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।” (সহীহ বুখারী: ১)
তাঁর এই আপাত সাধারণ আমলটি একনিষ্ঠ নিয়তের কারণেই আল্লাহর কাছে এক অসাধারণ ইবাদতে পরিণত হয়েছিল।
নিজস্ব প্রতিফলন:
আমরা প্রায়ই বড় বড় আমল বা অনেক বেশি তেলাওয়াতের পেছনে ছুটি, কিন্তু ইখলাস বা আন্তরিকতার কথা ভুলে যাই। এই ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, অল্প আমলও যদি গভীর ভালোবাসা ও আন্তরিকতা-র সাথে করা হয়, তা আল্লাহর কাছে পাহাড়সম প্রতিদান বয়ে আনতে পারে।
মৃত্যুর পর যখন ঘটলো অলৌকিক ঘটনা

একদিন সেই আল্লাহর গোলাম ইন্তেকাল করলেন। গ্রামের অজ্ঞতার কারণে কেউ তাঁর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে পারছিল না। অবশেষে, তারা অসহায় হয়ে লাশটি সাদা কাপড়ে ঢেকে রাস্তার পাশে রেখে দিল এই আশায় যে, কোনো দ্বীনদার বা আলেম ব্যক্তি হয়তো সেদিক দিয়ে যাবেন এবং মৃতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করবেন।
কিছুক্ষণ পর সরকারি চাকরিজীবী এক দ্বীনদার ব্যক্তি সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। মানুষের ভিড় দেখে তিনি এগিয়ে যান এবং ঘটনা জানতে পারেন। অফিসের তাড়া থাকা সত্ত্বেও গ্রামবাসীর আন্তরিক অনুরোধে তিনি নিজের কাজের ঝুঁকি নিয়েও লোকটির গোসল, কাফন এবং জানাজা সম্পন্ন করে নিজ হাতে কবরে দাফন করেন।
যখন কবর থেকে ছড়িয়ে পড়লো জান্নাতের সুবাস
দাফন শেষে অফিসে পৌঁছে সেই ব্যক্তি খেয়াল করেন, তাঁর অফিসের দরজা খোলার কার্ডটি হারিয়ে গেছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হলো, কার্ডটি হয়তো দাফনের সময় কবরের পাশে কোথাও পড়েছে। তিনি আবার সেই গ্রামে ফিরে আসেন এবং গ্রামবাসীর সহায়তায় কবরটি পুনরায় খনন করার সিদ্ধান্ত নেন।
কবরের মাটি সরাতেই এক আশ্চর্যজনক ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো! কবর থেকে মিশকে আম্বরের চেয়েও তীব্র ও সুমধুর ঘ্রাণ বের হতে শুরু করলো এবং মুহূর্তের মধ্যে তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। সবাই হতবাক! কারণ এই ব্যক্তি কোনো বড় আলেম, পীর বা হাফেজে কোরআন ছিলেন না; ছিলেন একজন সাধারণ নিরক্ষর দিনমজুর। তাহলে তাঁর কবরে এমন জান্নাতি সুবাস কেন?
নিজস্ব প্রতিফলন:
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের সম্মান দুনিয়াতেও প্রকাশ করে দেন, যাতে অন্যরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এই অলৌকিক ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর রহমত কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। ইখলাস থাকলে একজন সাধারণ দিনমজুরও আল্লাহর 'অলি' বা বন্ধুর মর্যাদা পেতে পারেন।
যে ভালোবাসার কাছে অক্ষরজ্ঞান হার মানলো

এই অলৌকিক ঘটনা সেই দ্বীনদার ব্যক্তির কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। তিনি মৃতের মেয়ের কাছে গিয়ে তার বাবার বিশেষ কোনো আমল সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মেয়েটি জানাল, তার বাবা একজন সাধারণ দিনমজুর ছিলেন, কিন্তু প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে একটি কিতাব খুলে তার উপর আঙ্গুল বুলিয়ে কাঁদতেন আর বলতেন, "আমার মালিক যা বলেছেন, সব সত্য।"
যখন সেই কিতাবটি আনা হলো, দেখা গেল সেটি দুনিয়ার কোনো সাধারণ বই নয়, বরং তা ছিল আসমানী কিতাব, মহাগ্রন্থ আল-কোরআন।
তখনই সবাই বুঝতে পারলো, এই ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলেও, তাঁর অন্তরে ছিল কোরআনের প্রতি গভীর, শর্তহীন বিশ্বাস ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে এত বড় মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর কবরকে আল্লাহ জান্নাতের বাগান বানিয়ে সুগন্ধে ভরিয়ে দিয়েছেন, যা মানুষকে জান্নাত কেমন হবে তার এক ঝলক দুনিয়াতেই দেখিয়ে দিল।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অনুবাদ: “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)
এই ব্যক্তির তাকওয়া ছিল তাঁর অন্তরের গভীরে, তাঁর ভালোবাসায় এবং তাঁর বিশ্বাসে।
এক নজরে কোরআন প্রেমের এই কাহিনী
- 📖 মূল চরিত্র: একজন নিরক্ষর দিনমজুর, যার অন্তরে ছিল কোরআনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
- 💧 বিশেষ আমল: প্রতিদিন কোরআনের পাতায় আঙুল বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বলা, "আমার মালিক যা বলেছেন, সব সত্য।"
- ✨ অলৌকিক ঘটনা: মৃত্যুর পর তাঁর কবর থেকে জান্নাতের মতো সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়া।
- ❤️ মূল শিক্ষা: আল্লাহর কাছে পাণ্ডিত্য বা বাহ্যিক আমলের চেয়ে অন্তরের ইখলাস, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অধিক মূল্যবান।
- 🔑 আমাদের পথ: কোরআনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা, তা পাঠ করে, বুঝে, ভালোবেসে এবং আমল করার মাধ্যমে।
আমাদের জন্য শিক্ষা: ভালোবাসা যখন শ্রেষ্ঠ আমল
এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা বান্দার বাহ্যিক আমল বা পাণ্ডিত্যের চেয়ে অন্তরের ইখলাস ও বিশুদ্ধ ভালোবাসাকে বেশি গুরুত্ব দেন। নবীজি (ﷺ) কোরআনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চারটি পথ বাতলে দিয়েছেন:
- কোরআন পড়া: নিজে বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা।
- কোরআন পড়ানো: অন্যকে কোরআনের শিক্ষা দেওয়া।
- কোরআনওয়ালাদের ভালোবাসা: যারা কোরআন পড়েন বা পড়ান, তাদের প্রতি হৃদয়ে সম্মান ও মহব্বত রাখা।
- কোরআনের ওপর আমল করা: কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
সেই দিনমজুর হয়তো প্রথম, দ্বিতীয় বা চতুর্থটি করতে পারেননি, কিন্তু তৃতীয়টির সারমর্ম—কোরআনের প্রতি ভালোবাসা—তিনি তাঁর সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে পালন করেছেন। এই ভালোবাসাই তাঁকে আল্লাহর কাছে এতটা প্রিয় করে তুলেছে এবং তাঁর নাজাতের ওসিলা হয়ে গেছে।
মূল আলোচনাটি ভিডিওতে শুনুন
করণীয় তালিকা: আজ থেকেই শুরু করুন
- কোরআনের জন্য সময় বের করুন: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন, যখন আপনি শুধু কোরআন পড়বেন বা শুনবেন। ৫ মিনিটের জন্য হলেও এই অভ্যাসটি গড়ে তুলুন।
- অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন: তেলাওয়াতের পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত একটি আয়াতের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির পড়ুন। এতে কোরআনের প্রতি আপনার ভালোবাসা গভীর হবে।
- আলেমদের সম্মান করুন: যারা কোরআনের ধারক-বাহক, সেই আলেম ও হাফেজদের সম্মান করুন, তাদের সঙ্গ লাভের চেষ্টা করুন। এটিও কোরআনকে ভালোবাসার একটি অংশ।
- কোরআনের জন্য দোয়া করুন: আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, "হে আল্লাহ, আমার অন্তরে কোরআনের ভালোবাসা বাড়িয়ে দিন এবং এর আলোকে জীবন গড়ার তাওফিক দিন।"
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রশ্ন ১: এই ঘটনাটি কি কোনো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত?
উত্তর: এটি সরাসরি কোনো হাদিস নয়, বরং আলেমদের বয়ানে বর্ণিত একটি শিক্ষামূলক ঘটনা বা কিসসা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামের মৌলিক নীতি—যেমন ইখলাস, আল্লাহর কালামের প্রতি ভালোবাসা এবং নিয়তের গুরুত্ব তা তুলে ধরা, যা কোরআন ও হাদিসের বহু দলিল দ্বারা সমর্থিত।
প্রশ্ন ২: তাহলে কি কোরআন পড়া না শিখলেও চলবে, শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট?
উত্তর: না, এই ধারণাটি ভুল। প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য কোরআন পড়া শেখা একটি আবশ্যকীয় দায়িত্ব। এই ঘটনাটি তাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, যারা কোনো কারণে শিখতে পারেননি বা যাদের সুযোগ সীমিত। এটি শেখার গুরুত্বকে মোটেও কমায় না, বরং ইখলাসের গুরুত্বকে তুলে ধরে। ভালোবাসা শেখার প্রথম ধাপ।
প্রশ্ন ৩: আমি কোরআন পড়তে পারি, কিন্তু অন্তরে এমন ভালোবাসা অনুভব করি না। আমার করণীয় কী?
উত্তর: কোরআনের অর্থ ও এর পেছনের প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করুন। এটি কার বাণী, কেন পাঠানো হয়েছে—তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। আল্লাহর মহত্ত্ব ও দয়া নিয়ে ভাবুন। নিয়মিত দোয়া করুন এবং কোরআন অনুযায়ী জীবনযাপনের চেষ্টা করুন। ইনশাআল্লাহ, ধীরে ধীরে আপনার অন্তরে এর ভালোবাসা জন্মাবে।